প্রতি পদে ছিল মৃত্যুর আশঙ্কা। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে হাড় হিম করা ঠাণ্ডা, বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রায় ৭ কিলোমিটার দল বেঁধে হেঁটে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছেছিলেন কোচবিহারের ৫ জন বাসিন্দা। রাত কাটিয়েছেন রাস্তার ধারে ভিখারিনির ডেরায়। সেখান থেকে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় শুক্রবার সকালে কোচবিহারে ফিরেছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে ৪ জনই মহিলা। কোচবিহারের কলাবাগান ও লাগোয়া এলাকার বাসিন্দারা নয়াদিল্লি থেকে সম্পর্কক্রান্তি এক্সপ্রেসে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামেন। সেখান থেকে ট্রেন ধরে নিউ কোচবিহার স্টেশনে যান। |
উত্তরাখণ্ড থেকে ফিরে নিউ কোচবিহার স্টেশনে।—নিজস্ব চিত্র। |
কোচবিহারের বাড়িতে বসে ওই বর্ণনা দিতে গিয়ে আতঙ্কে কেঁদে ফেলেন প্রতিভা চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, “ওই দিন মানে ১৬ জুন, আমরা গঙ্গোত্রীতে ছিলাম। সকাল থেকে গঙ্গার জল বাড়ছিল। জানালার কাচ দিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা গঙ্গাকে দেখে নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করেছিলাম। চোখের সামনে সেই বাঁধটা তলিয়ে যায়। গঙ্গার তীব্র জলোচ্ছ্বাস যেন ক্রমশ হোটেলের দিকে তেড়ে আসে। হোটেল মালিক অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন। তখন সরে যাই।” তখন প্রতিভা দেবীরা এক ভিখারিনির ঘরে আশ্রয় নেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে মীরা লাহিড়ি বলেন, “হোটেল থেকে উঁচু পাহাড়ে ভিখারিনির ঘর অন্তত ৭ কিলোমিটার তো হবেই। আমরা যেতেই ঘরে উনি আগুন জ্বেলে গরম হওয়ার ব্যবস্থা করলেন। লাল চা দিলেন। সঙ্গে বিস্কুট। ওই বৃদ্ধা রাতে ছোলা ভাজা খান। তা-ও আমাদের খেতে বলেছিলেন। যদিও ওই বাড়ির আশেপাশেও ধস পড়ছিল। বরাত জোরে ওই বাড়ির ক্ষতি হয়নি।”
প্রতিভাদেবী, মীরাদেবীরা জানান, ওই ভিখারিনির বয়স প্রায় ৮০। তিনি সেখানে একাই থাকেন। হিন্দিতে কথা বলেন। তাঁর আদি বাড়ি পটনায়। স্থানীয় একটি মন্দিরে ভিক্ষা করে কোনওমতে দিনগুজরান করেন। বৃদ্ধার পাথরের দেওয়াল ও অ্যাসবেস্টসের চাল দেওয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দু’টি ঘরে সেই রাত কাটান প্রতিভাদেবীরা ৫ জন। ঘরে শোওয়ার কোনও জায়গা নেই। চট পেটে কম্বল মুড়ে শুতে হয়েছিল। কিন্তু আতঙ্কে কারও ঘুম হয়নি।
জলোচ্ছ্বাস কমার পরে হোটেলে আশ্রয় নেন। কিন্তু প্রবল ক্ষয়ক্ষতিতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রসদ ফুরিয়েছে। পানীয় জল নেই। লোডশেডিং। অগত্যা বৃষ্টির জল খেয়ে টানা দু’দিন কাটাতে হয়। দু’দিন পরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার হেঁটে হরসিল সেনা ক্যাম্পে যান ১২ জন। একমাত্র অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকা মীরাদেবী সাত হাজার টাকায় ডুলি ভাড়া করে সেখানে আসেন। তিনি বলেন, “হরসিলের সেনা ক্যাম্পে যাওয়ার পরে জওয়ানরা খাবার ওষুধ, থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এমনকী, নিজেরা আমাদের ব্যাগপত্র পর্যন্ত তুলে নেন। ওঁদের এমন সাহায্য জীবনে ভুলব না। সেনাবাহিনীর জন্য আমাদের গর্ব হয়।” হরসিল থেকে দু’দিনের মাথায় হেলিকপ্টারে তাদের চিনোলিসোর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর বাসে হৃষীকেশ-হরিদ্বার হয়ে দিল্লিতে পৌঁছন। কার্তিক মন্ডল, লক্ষ্মী মন্ডল, নরোত্তম দাস, রীতা ভদ্র, মনোজ সাহাদের চোখে মুখে তখন স্বস্তির ছাপ। তাঁদের কয়েকজনের কথায়, “দিল্লি কালীবাড়িতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে নিখরচায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ফেরার আগে সবাইকে ৩০০ টাকা করে নগদ দেওয়া হয়। ওই পরিস্থিতিতে ওই টাকাটা দারুণ কাজে লেগেছে।” |