রমজানে ভোট নিয়ে প্রশ্ন মমতার
আগেই হতে পারত ভোট, সরকারকে বিঁধল বিরোধীরা
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে অবশেষে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে পঞ্চায়েত ভোট-জট কাটল। কিন্তু দেরির কারণকে কেন্দ্র করে শাসক ও বিরোধী পক্ষের চাপানউতোর রয়েই গেল!
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে প্রত্যাশিত ভাবেই স্বাগত জানিয়েছে বিরোধীরা। সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি-সহ সব বিরোধী দল যখন পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে এত দিন ধরে টালবাহানার জন্য রাজ্য সরকারের অনমনীয় মনোভাবকেই দায়ী করছে, তখন সরকারের নিশানায় বিরোধীরা! তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী আঙুল তুলেছেন সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ‘চক্রান্তে’র দিকে! তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, হারের ভয়ে বিরোধীরা ভোট আটকাতে চাইছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই ‘চক্রান্ত’ ব্যর্থ হয়েছে। তবে রমজানের সময় ভোট নিয়ে অসন্তোষ গোপন করেননি মুখ্যমন্ত্রী।
শুক্রবার হুগলির পাণ্ডুয়ায় পঞ্চায়েতের প্রচারে গিয়ে বিরোধী পক্ষ এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে নিশানা করে মমতা বলেন, “পাঁচ বারে হোক বা পঞ্চাশ বারে, ভোট তোদের করাতেই হবে! আর জিতব আমরাই! সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি, কেউ দাঁড়াতে পারবে না!” বিরোধীদের উদ্দেশে তৃণমূল নেত্রী আরও বলেন, “আমরা এ ভাবে চাইনি। কিন্তু অনেক সময় এমন পরিস্থিতি হয়, সরকার বাধ্য হয়। তোমরা ভাবছো, ভোট যত পিছিয়ে যায়, তত মঙ্গল! যত কম ভোট পড়বে, তোমরা জিতে যাবে! তা হবে না! প্রয়োজনে বন্যার জলেই নির্বাচন হবে! আর তোমরা চিঁড়ের পাত্র নিয়ে ভোট চাইতে যাবে!”
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য ভোট-বিলম্বের জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। সরকারের মনোভাব নিয়ে তাঁর কটাক্ষ, “কথায় বলে, সেই যদি মল খসালি, তবে কেন লোক হাসালি!” তিনি আরও বলেন , “কেন এই বিলম্ব, এত দিনে পরিষ্কার। এর পর জনগণের সুপ্রিম কোর্টে তার রায় বেরোবে!” তিন মাস ধরে চলা মামলা যে ভাবে সর্বোচ্চ আদালতে কয়েক ঘণ্টায় নিষ্পত্তি হল, তা নিয়েও রাজ্যের দিকেই আঙুল তুলে সূর্যবাবু বলেন, “যা খবর মিলেছে, রাজ্যের আইনজীবী অনেকটা নমনীয় হয়েছেন। এত দিন অনমনীয় ছিলেন। আগে নমনীয়তা দেখালে জটিলতা আগেই কেটে যেতে পারত!” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও তৃণমূলকে বিঁধে বলেন, “তৃণমূল গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই চেষ্টা বানচাল হয়ে গিয়েছে।
বারাসতের সভায় মানিক সরকার। —নিজস্ব চিত্র
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধিকার শেষ পর্যন্ত কায়েম থাকায় খুশি কংগ্রেসও। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যেই রাজ্য সরকার কমিশনের ক্ষমতা ছিনতাই করতে গিয়েছিল! কিন্তু আদালতের রায়ে প্রমাণিত হল, কমিশনের নির্দেশে রাজ্য প্রশাসনকে পরিচালিত হতে হবে। রাজনৈতিক দলের নির্দেশে কমিশনকে পরিচালিত করা আর সম্ভব হবে না।”
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে এত দিনের জটিলতারও নিষ্পত্তি করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার মত, “মনোনয়ন পর্বে যদি কেন্দ্রীয় বাহিনী আসত, তা হলে ৬৬২৫ জন তৃণমূল প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারত না! আশা করি ভোটারেরা এ বার নিরাপত্তার মধ্যে ভোট দিতে পারবেন।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, “ভোট শেষ পর্যন্ত হচ্ছে এবং রাজ্য একগুঁয়েমির উচিত শিক্ষা পেয়েছে! এতে আমরা আনন্দিত।”
কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট করানোর প্রসঙ্গ তুলে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে এসে সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্য এ দিন বলেন, “জোতদার-জমিদারদের সাহায্য করার জন্যই নির্বাচন ভণ্ডুল করার চেষ্টা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, রাজ্যের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম কোনও রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট হচ্ছে! এর থেকেই স্পষ্ট, এ রাজ্যের কী ভয়ঙ্কর অবস্থা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার কী ভাবে এখানে লুণ্ঠিত হচ্ছে!” তৃণমূলের প্রতি মানিকবাবুর কটাক্ষ, “জনগণের উপরে ওরা আস্থা রাখতে পারছে না। জনগণ ওদের উপরে আস্থা হারিয়েছে!”
মমতা অবশ্য এ দিন বারেবারে বোঝাতে চেয়েছেন, ভোট আটকাতে মরিয়া ছিল বিরোধীরাই। একই কথা বলেছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। এ দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে পঞ্চায়েতের প্রচারে গিয়ে পার্থবাবু বলেন, “আমরা যেতে চাই ভোটে, ওরা যেতে চায় কোর্টে। ওরা সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে। সেখানেও কব্জা করতে পারল না। পাঁচ দফায় ভোট হচ্ছে।” অন্য দিকে মমতা আশাবাদী, ভোট যখনই হোক, মানুষ এ বার পঞ্চায়েতে ‘পরিবর্তনে’র পক্ষেই রায় দেবেন। যার জন্য প্রয়োজনে ‘বন্যায় এক গলা জলে’ দাঁড়িয়েও মানুষকে ভোট দিতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে রমজান ও বর্ষায় ভোটের পক্ষপাতী যে তাঁরা ছিলেন না, তা-ও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। পাণ্ডুয়ায় যাওয়ার পথে এ দিন বারেবারেই দিল্লিতে ফোনে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাণ্ডুয়ার মহানাদ হাইস্কুল মাঠে মঞ্চে পৌঁছেও বারবার খবর নিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। মোবাইল হাতে এক বার মঞ্চ থেকে নেমেও আসেন কথা বলতে বলতে। বক্তৃতার ঠিক আগেই ‘তোরা’ সম্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোনে কাউকে বলতে শোনা যায়, রমজান মাসেই ভোট কেন মেনে নেওয়া হল?
মমতা বক্তৃতায় বলেন, “আমরা বারবার চেষ্টা করার পরেও ওরা চক্রান্ত করে সব গোলমাল করে দিল! রমজান মাসে আদালত নির্দেশ দিলে আমরা তখনই ভোট করতে বাধ্য থাকব। তবে রমজান বা দুর্গাপুজোর সময় ভোটআমি দু’টোরই বিরোধী। তা ছাড়া, এই সময়ে বন্যা হতে পারে।”
রমজান নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অসন্তোষের জবাবে বিরোধীরা অবশ্য সরকারের অনমনীয় মনোভাবকেই দুষছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর কথায়, “এটা ভাল লক্ষণ যে, সহমতের ভিত্তিতে ভোট হতে যাচ্ছে। যদিও বর্ষা, রমজান, রথযাত্রা এ সবের সমস্যা আছে। তবু আমরা মনে করি, এটা একটা বহু প্রতীক্ষিত এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।” কংগ্রেসের মানসবাবুর যুক্তি, “রাজ্যের জেদ ও একগুঁয়েমিতেই ভোট পিছিয়েছে। কমিশনের সঙ্গে সহমত হয়ে কাজ করলে এপ্রিলেই ভোট হয়ে যেত! একটু অসুবিধা তো আমাদের সংখ্যালঘু ভাইবোনেদের হবে। এর জন্য যদি কেউ দায়ী থাকে, সেটা রাজ্য সরকার!” রমজানে ভোট নিয়ে সরকারের বক্তব্যকে কটাক্ষ করে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান আবার বলেন, “বাইরে এসে বিবৃতি দিচ্ছে রমজান মাসে চাইনি! আদালতের ভিতরে তো মেনে নিয়েছে!”
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে তৃণমূলের আইনজীবী-সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের কড়া সমালোচনা করেন। তাঁর অভিযোগ, সিপিএম এবং কংগ্রেসকে মদত দেওয়ার কাজ করেছেন মীরা। আদালতে এ দিন আবদুল মান্নানের উপস্থিতি নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি কল্যাণ! যার জবাবে মান্নান বলেছেন, “আমি দর্শক হিসেবে আদালতে যেতেই পারি! এতে অন্যায় কী হয়েছে?”

রমজান মাসে ভোট কেন, মামলার হুমকি
সুপ্রিম কোর্টের ফয়সালায় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের জট কেটেছে। কিন্তু রমজান মাসে ওই ভোটের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিল সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশন। শুক্রবার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান বলেন, “রমজান মাসে পঞ্চায়েত ভোট মানব না। আদালতে যাব। প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টেও।” তাঁর কথায়: আমরা চাই, সকলেই ভোট দিক। সেই সঙ্গে ভোটকর্মীরাও নিজেদের ধর্মীয় আচরণ মেনে চলার সুযোগ পান। কিন্তু রমজানে ভোট হলে রোজাদারদের পক্ষে ভোট পর্বে যোগ দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আবার ওই সময়ে ভোটকর্মীদের পক্ষে ধর্মপালন করাও প্রায় অসম্ভব। কারণ, ভোটের এক দিন আগে ভোটকর্মীদের কর্মস্থলে চলে যেতে হবে। সেখানে তাঁরা সেহেরি (ভোরের খাবার) খেতে পারবেন না। একই ভাবে রোজা ভাঙা তথা ইফতারের ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। তাই রমজান মাসে ভোট মানব না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.