|
|
|
|
সংখ্যাই দেয় উন্নয়নের চাবিকাঠি
আজ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের একশো বিশতম জন্মদিন। তাঁর কাজ নিয়ে লিখছেন ওঙ্কার প্রসাদ ঘোষ। |
সদ্য ভারত স্বাধীন হয়েছে। অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু একটি অদ্ভুত সমস্যা সমাধানের কাজ দিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একদল শরণার্থী এসে লালকেল্লায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, প্রশাসনের কাউকে সেখানে ঢুকতেই দিচ্ছেন না। কেবল তাঁদের খাবার সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি স্থানীয় ঠিকাদারি সংস্থার লোকেরাই প্রবেশ করতে পারছে। আর এই সুযোগে সেই ঠিকাদারি সংস্থা শরণার্থীদের একটা মস্ত সংখ্যা দেখিয়ে মোটা অঙ্কের বিল পাঠাচ্ছে সরকারের কাছে। সেই মুহূর্তে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, আইনের জোরে লালকেল্লার ভিতরে ঢুকে শরণার্থীদের মাথা গোনা সম্ভব নয়। অগত্যা সরকার দ্বারস্থ হল ‘পিসিএম’-এর। ভিতরে না-ঢুকেই বলতে হবে, শরণার্থীর সংখ্যা কত।
প্রশান্তচন্দ্র ও তাঁর ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের (আইএসআই) সহযোগীরা যে পদ্ধতিটি গ্রহণ করলেন, সেটি এক কথায় নজিরবিহীন। লালকেল্লা সংলগ্ন অঞ্চলে যত মুদির দোকান ছিল সেখান থেকে শরণার্থীদের আসার আগে ও পরের সময়ে লবণের বিক্রিবাটার বিশদ তথ্য নিলেন তাঁরা। তাঁরা দুটি কথা ধরে নিলেন। এক, মাথাপিছু লবণের ব্যবহার একটি নির্দিষ্ট মাপেরই হয়। আর দুই, স্বাধীনতার আগে আর পরে, এই দুই সময়ের মধ্যে স্থানীয় দোকানগুলি থেকে যে অতিরিক্ত লবণ বিক্রি হয়েছে, তা লালকেল্লার শরণার্থীদের খাদ্য প্রস্তুতিতেই ব্যবহার হয়েছে। এর ভিত্তিতে তাঁরা শরণার্থী সংখ্যার একটা হিসেব দেন যেটা ঠিকাদারি সংস্থার দেওয়া সংখ্যার তুলনায় নেহাতই নগণ্য। অবস্থা স্থিতিশীল হলে যখন প্রকৃত শরণার্থী সংখ্যা পাওয়া গেল, তখন দেখা গেল তাঁদের অনুমান আসল সংখ্যার প্রায় সমান। একটি সদ্য-স্বাধীন দেশের প্রশাসনিক আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে এটি একটি অত্যন্ত বিশেষ ঘটনা। |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সস্ত্রীক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। |
মানুষের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করতে হলে তার ভিত্তি যে থাকতে হবে সংখ্যাতত্ত্বে, এ কথাটি ভারতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। আর তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের পদ্ধতিও যাতে হয় ভ্রান্তিহীন, বিজ্ঞানসম্মত, সেদিকেও তাঁর সতর্কতার অন্ত ছিল না। তাই স্বাধীনতার অনেক আগে প্রশান্তচন্দ্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের মধ্যে জাতীয় স্যাম্পল সার্ভে ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। নমুনা সমীক্ষার কাজে সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়োগ কেমন হবে, তা তিনি হাতে-কলমে করে দেখাতে চেয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পরে প্রশান্তচন্দ্রের কাজের গুরুত্ব স্বীকার করে সরকারের অধীনে ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। আজ গোটা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই সংস্থার পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের থেকে বিশদ তথ্য নেওয়া হয়। চাল-ডাল-তেল-নুন, ওষুধ বা জামাকাপড় কিনতে কত খরচ করে পরিবারগুলি, কত মানুষ কাজ করছেন আর কতজন কর্মহীন, পরিবারের খাবারের কতটুকু আসছে রেশন দোকান থেকে, এমন সব তথ্য উঠে আসে সমীক্ষা থেকে। সরকারি পরিকল্পনা, প্রকল্প কতটা কার্যকরী হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কতটুকু পৌঁছচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে, তার বোঝার প্রধান উপায় এই সমীক্ষাগুলিই। মানুষের দৈনন্দিন জীবন বুঝতে, তার চাহিদা-পছন্দ-আকাঙ্খার হদিশ পেতে সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্য নিতেই হবে, এই সত্যটা এ দেশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র।
সংখ্যাতত্ত্বকে মানুষের কাজে, দেশের কাজে লাগানোর জন্য মানবসম্পদ তৈরি করা, এবং সহায়ক প্রযুক্তি জোগানোর জন্য প্রশান্তচন্দ্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতীয় সংখ্যাতত্ত্বের জনক এই ইস্পাত কঠিন মানুষটি চলে গিয়েছেন প্রায় চল্লিশ বছর আগে। রয়ে গিয়েছে তাঁর সাধের আইএসআই। আজও সংখ্যাতত্ত্বের পঠনপাঠন ও গবেষণায় সারা বিশ্বের অন্যতম অগ্রগণ্য কেন্দ্র। আর রয়ে গিয়েছে তাঁর তৈরি ভারতের পরিসংখ্যান পরিকাঠামো, আন্তর্জাতিক স্তরে যা আক্ষরিক অর্থেই রোল মডেল। তবে জাতীয় স্তরে এই প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো শক্তপোক্ত হলেও, রাজ্য স্তরে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। সে দিকে নজর দেওয়া দরকার।
আর যা দরকার, তা হল তাঁর মতাদর্শকে অনুসরণ করে সমীক্ষাপ্রাপ্ত তথ্য দিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা। কেন্দ্রীয় স্তরে তা অনেকটা করা হয়, কিন্তু পুরসভা বা কর্পোরেশনের মতো স্থানীয় সরকারগুলির পরিকল্পনায় সমীক্ষা-ভিত্তিক পরিসংখ্যানের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। তার বাইরেও, তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নমুনা সমীক্ষা খুব দরকার। কোনও পণ্য বাজারে চলবে কি না, আগামী নির্বাচনে হাওয়া ঘুরবে কি না, এমন নানা বিষয়ে প্রশ্ন নিয়ে নাগরিকদের কাছে প্রশ্ন নিয়ে যান সমীক্ষকরা। দুঃখের বিষয়, কখনও কখনও নাগরিকরা তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেন। নাগরিকদের সহযোগিতা ছাড়া উৎকৃষ্ট তথ্য জোগাড় করা সম্ভব নয়।
আনন্দের কথা এই যে, প্রশান্তচন্দ্রের প্রদর্শিত পথকে আরও উজ্জ্বল, মসৃণ করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সার্বিক উন্নয়নের দিশা দিতে গঠিত হয়েছে জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন। নয়ডায় গড়ে উঠেছে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)। নাসা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে পেশাদার পরিসংখ্যানবিদদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। স্নাতকোত্তর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য চালু করা হয়েছে ‘সামার ইন্টার্নশিপ’, যেখানে তারা সরকারি পরিসংখ্যান বিভাগে হাতে-কলমে কাজ শেখার সুযোগ পান।
পরিসংখ্যান চর্চার এই নবজাগরণের মুহূর্তে প্রশান্তচন্দ্রকে কি ভুলে থাকা যায়?
তাঁর জন্মদিন ২৯ জুনকে ‘জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস’ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। জনসাধারণের কাছে, বিশেষত ছাত্রছাত্রীদের কাছে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক তুলে ধরে তাদেরকে সংখ্যাতত্ত্বে উৎসাহিত করাই এই দিনটির মূল উদ্দেশ্য। এর সঙ্গেই, সমীক্ষার সময় সাধারণ মানুষের সহায়তা কতটা জরুরি, সেই বার্তাও তুলে ধরার একটা সুযোগ তৈরি করা হয়। সমীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনে রাখতে হবে, প্রশান্তচন্দ্রই সেই মানুষ যিনি সব নাগরিকের সব কথাকে সংখ্যায় পরিণত করে, সেই সংখ্যা দিয়ে দেশের প্রকৃত ছবি তুলে ধরতে শিখিয়েছিলেন। |
লেখক এনএসএসও-এর ফিল্ড ডিভিশনের উত্তরবঙ্গের অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত। |
|
|
|
|
|