|
|
|
|
মৃত্যুকে ছুঁয়ে প্রায়শ্চিত্তে নেমেছেন দেবেশ
অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
ম্যায়নে মওতকো দেখা...
ফোনের উল্টো দিকে দেবেশ শুক্লজির গলা কেঁপে উঠল স্পষ্টই।
...আপনে আঁখো সে দেখা, উও কেয়া চীজ হ্যায়।...
দেবেশ শুক্ল কেদারনাথ মন্দিরের পুরোহিত। অনেক পুরোহিতের এক জন। চলে যাওয়া একটা সপ্তাহ যেন বছর তিরিশ বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা।
...ইতনি করিব সে দেখা, য্যায়সা লোগ আখোড়া মে খাড়া হো-কর কুস্তি কি দাওপ্যাঁচ দেখতা...
মৃত্যু যখন নেমে আসছে পাহাড় বেয়ে, বছর পঞ্চান্নর শুক্লজি তখন তিন তলা মঙ্গলম লজের ছাদে। পুজো-আচ্চা তো ছিলই, এই ধর্মশালাটিও চালাতেন। একলা নন, ম্যানেজার গোপীনাথ, রাঁধুনি নেগী-সুনীল, যাত্রীদের ফাইফরমাস খাটার দুই ভাই হরি আর ভরত। চোখের সামনে বয়ে গিয়েছেন এঁরা এক এক করে। ঠিক সামনে গায়ত্রী লজ চলাতেন শুক্লজির এক রিস্তেদার। ১৬ জন যাত্রী-সমেত তা মিলিয়ে যেতে দেখেছেন নদীর হাঁ-য়ে। ৫২ ঘণ্টা পরে শুক্লজি ‘সহি সলামত’ ঘরে ফিরেছেন, কিন্তু এ যেন অন্য মানুষ!
গুপ্তকাশী থেকে কিলোমিটার আটেক চড়াই ভেঙে খেগু পঞ্চায়েতের পওলা গ্রামে ঘরে ঘরে বিলাপ। বিদ্যুৎ নেই দিন দশেক। রাস্তা ভেঙে নেমে গিয়েছে মন্দাকিনীর গর্ভে। চুলা জ্বালানোর মিট্টি-কা তেলের ফোঁটাটুকুও নেই কোনও ঘরে। খেতের সব্জি কিছু রয়েছে, তো রোটি-চাপাটি বেখবর। আটা বাড়ন্ত। |
চলছে উদ্ধার কাজ। ছবি: পিটিআই। |
খাবার-দাবারে অবশ্য মন নেই পাওলার। শুক্লজির মতো এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই বেঁচে ছিলেন কেদারনাথকে আঁকড়ে। কেউ পুরোহিত, তো মন্দিরের গায়ে কারও পুজোর সরঞ্জামের দোকান। কেউ ধর্মশালা চালাতেন, তো কেউ সেখানে রান্নাবান্না-কাজকর্ম।
শুধু পাওলা গ্রামেই ৩৭ জন ঘরে ফেরেননি। ৫৩ জন ফিরেছেন চিরপঙ্গু হয়ে। শুধু তো প্রতিবেশী নন, গ্রামবাসীরা যে ঘর-ঘর আত্মীয়।
হেলিকপ্টার ফাটার কাছে সিরসিতে নামিয়ে দেওয়ার পরে জঙ্গলপথে ১৫ কিলোমিটার হেঁটে গুপ্তকাশী পৌঁছেছিলেন শুক্লজি। সেখান থেকে আরও আট কিলোমিটার কার্যত হামাগুড়ি দিয়ে পাওলায় যখন পৌঁছলেন, বাড়ির লোক পারলে গা ছুঁয়ে পরখ করে নেন ভূত নয় তো!
কী ভাবে পাওলায় খবর পৌঁছে গিয়েছিল, গোপীনাথ, সুনীল, নেগীদের সঙ্গে দেবেশজিও ভেসে গিয়েছেন। বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠেন শুক্লজি। বাড়িতে তিন দিন নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। বুড়ি মা কেঁদেই গিয়েছেন। মেয়েরাও। শুধু চোয়াল চেপে ঘরকন্নার জোয়াল নিজের কাঁধে আরও চেপে বসিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন প্রৌঢ়া স্ত্রী। শুক্লজি ফেরার পরে জড়িয়ে ধরে আর একপ্রস্ত কান্নাকাটি।
গেল সোমবারের সেই সাতসকালে ছাদে আপনি কী করছিলেন শুক্লজি?
শনিবার থেকে যে বৃষ্টি নেমেছিল, তিন দিন তা ছিল অবিরাম। রবিবার সন্ধেয় বড় বড় পাথর পড়তে থাকে পাহাড় বেয়ে। সবাই ভেবেছিল, হিমবাহ ফেটেছে, মন্দাকিনী হিমবাহ। ভারত সেবাশ্রম, বিড়লা গেস্ট হাউস বা আশপাশের লোকেদের সরিয়ে আনা হচ্ছিল। গোপীনাথ-সুনীলরা যাত্রীদের সঙ্গে গিয়ে মালপত্র নিয়ে আসছিলেন। একতলায় জল ঢুকে যাওয়ায়, শুক্লজি পলিথিনের চাদর টাঙাচ্ছিলেন ছাদে, যাতে আরও কিছু লোক আশ্রয় পেতে পারেন। ঠিক তখনই শব্দ বোমা ফাটার চেয়েও ভয়াল-ভয়ঙ্কর।
...শোচনেসে আভি মেরা পাঁও কাঁপ রহা হ্যায়, বাবুজি! ইতনা ডরপুক হাম কভি নেহি থে!
তার পরেই যেন পাহাড়টা ধসে পড়ল। হাতির পালের মতো বোল্ডার নেমে আসতে লাগল। জলের তোড়ে দেওয়াল টলে গেল, বন্ধ দরজা-জানলা উপড়ে মুহূর্তে নদীতে নেমে গেল একটার পর একটা বাড়ি। শয়ে শয়ে লোক কে কোথায় ছিটকে গেল জলের তোড়ে। মাটি আর পাথরের দশ-বারো ফুটের পরতে চরাচর ঢাকা পড়ে গেল।
...পানি-হি পানি। লেকিন পানি কে লিয়ে লোগোঁ নে তড়পতে মরা!
আহতদের মুখে জল দেওয়ার কেউ নেই, সকলে ইঁদুরের মতো দৌড়চ্ছেন প্রাণ বাঁচাতে। শুক্লজিও। আর এ জন্য তিনি যে কতটা ‘শর্মিন্দা’, তা কেদারনাথই জানেন।
দু’দিন একটু জুত করে ঘুমিয়ে নিয়ে তাই প্রায়শ্চিত্তে নেমেছেন দেবেশ শুক্ল। রোজ সকালে নেমে আসেন গুপ্তকাশীতে। ত্রাণ শিবির খুলেছে ভারত সেবাশ্রম। সন্ধে পর্যন্ত সেখানেই স্বেচ্ছাশ্রমিক।
গঢ়বাল রো রহে হ্যায়, বাবুজি! মেরে কো জরুরত হ্যায়...
|
পুরনো খবর: গিলে খেতে ফুঁসছে অলকানন্দা, পাড়ে পাথর আঁকড়ে রাত্রিবাস |
|
|
|
|
|