|
|
|
|
গিলে খেতে ফুঁসছে অলকানন্দা, পাড়ে পাথর আঁকড়ে রাত্রিবাস
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
পায়ের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অলকানন্দা।
কথাটা বলেই নিজেকে শুধরে নিলেন সোহন ঘোষ। বললেন, “বয়ে যাচ্ছে নয়, ফুঁসছে। আমরা জড়সড় হয়ে বসে আছি পাড়ে, একটা পাথর আঁকড়ে। একই ভাবে সারা রাত। চার দিক অন্ধকার। তিন-চার হাত দূরের নদী থেকে জল ছিটকে লাগছে গায়ে।”
অলকানন্দার রূপ দেখে অজানা আশঙ্কায় সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন সোহন। এই কি সেই হৃদি ভেসে যাওয়া অলকানন্দা? নাকি সর্বস্ব গিলতে উদ্যত রাক্ষসী! যাওয়ার সময় তার যা চেহারা ছিল, কয়েক দিনের ব্যবধানে ফুলেফেঁপে পাঁচ গুণ।
অতিবর্ষণে উত্তরাখণ্ডে খণ্ডপ্রলয়ের পরে ২২ জুন বদ্রীনাথ থেকে ১৬ কিলোমিটার হেঁটে অলকানন্দার তীরে পৌঁছন সোহন। সঙ্গে ৬১ বছরের বাবা আর ৬৪ বছরের প্রতিবেশী কাকু। হাড় হিম করা বিপর্যয়ের দিনগুলি কাটিয়ে বৃহস্পতিবার কলকাতায় পা রাখলেন বনগাঁর ২৯ বছরের যুবক সোহন। বিমানবন্দরে নেমে শোনালেন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর কথায়, “সে-দিন (২২ জুন) পাথর আঁকড়ে মনে হয়েছিল, আর বোধ হয় ফেরা হল না। জলস্রোতের কত আক্রোশ থাকতে পারে, না-দেখলে আন্দাজ করতে পারতাম না! যেন শত বছরের জমে থাকা প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে আমাদের গিলে ফেলার জন্য কূল ছাপিয়ে উঠে আসতে চাইছে অলকানন্দা।”
|
সোহন ঘোষ। |
নদীতীর ঘেঁষে হাতে গোনা কয়েকটি বড় পাথর। তারই একটায় ঠাঁই হয় সোহনদের। সেই পাথরের গায়ে গাদাগাদি করে আরও অন্তত ৪০টি মানুষ। হিমশীতল মৃত্যুর চাদরে মোড়া প্রলয়ের অন্ধকার। এক বার ঘাড় তুলে আকাশের অবস্থাটা ঠাহর করার চেষ্টা করছিলেন বাংলার যুবক। একটা বর্ষণ কী ভাবে ঘনিয়ে আনতে পারে চরম ক্ষণ, ভেবে বারবার শিউরে উঠছিলেন তিনি। সোহনের কথায়, “সে-রাতে অবশ্য আর বৃষ্টি হল না। আমরা বেঁচে গেলাম।”
বেঁচে ফেরাটা সোহনের ভাষায়, যেন আস্ত যুদ্ধ! ১৪ জুন বদ্রীনাথে পৌঁছনোর পরেই লড়াই শুরু।একটানা বৃষ্টি শুরু হয় সে-রাতেই। বদ্রীনাথে বাসের মধ্যে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বসে ছিলেন। সেই বাস ছাড়েনি। বদ্রীনাথে আটকে থাকতে হয়েছিল চার দিন। ১৮ জুন থেকে টানা তিন দিন সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে। বাবা-কাকুর জন্যও আসনের ব্যবস্থা করা যায়নি। অগত্যা ব্যাগ কাঁধে, বৃষ্টি মাথায়, ভেঙে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তায় পথ চলা শুরু।
বদ্রীনাথ থেকে অলকানন্দার পাড়ে সেই রাত কাটানোর পরে সকাল থেকে ৫০০ মানুষের পিছনে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন সোহন। তত ক্ষণে নদীর এ-পাড় থেকে ও-পাড়ে দড়ি টাঙিয়েছেন সেনাবাহিনীর জওয়ানেরা। সেই দড়ি ধরে নদী পেরিয়ে যাওয়ার লাইন। বাবা পারবেন তো! পারবেন তো ৬৪ বছরের কাকু! সোহন বলেন, “আমার স্ত্রী অর্পিতা পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় বসে কত টেনশন করেছে! কান্নাকাটি করেছে। বলেছে, ‘টিভিতে দেখছি, দড়ি ধরে সবাই ঝুলে ঝুলে নদী পেরোচ্ছে আর টেনশন
বেড়ে যাচ্ছে’।”
|
শহরে ফিরে অবশেষে স্বস্তি। |
সোহনেরাও ছিলেন সেই দলে। তাঁর কথায়, “অর্পিতা যেটা দেখতে পায়নি, সেটা ওই লাইন। ভোর থেকে সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে সন্ধ্যা ৭টায় দড়ি ধরে নদী পেরোনোর সুযোগ পেলাম। সেনাদের দেওয়া বিস্কুট আর জল ছিলই বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ।” অলকানন্দার অন্য পাড়ে পৌঁছতে রাত হয়ে যায়। রাত কাটে নদীর ধারেই। আবার সেই পাথর। আবার এক দুঃসহ ভয়ের রাত। পরের দিন ভোরে ফের পথ চলা। এ বার ২৮ কিলোমিটার।
এ দিন বিমানবন্দরে উপস্থিত পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। দিন দুয়েক আগেই তিনি ফিরেছেন উত্তরাখণ্ড থেকে। বললেন, “অলকানন্দা থেকে যোশীমঠ পৌঁছনোর সময় কখনও গাছের শিকড় ধরে, কখনও বুকে হেঁটে, কখনও বা পাহাড় টপকে যেতে হয়েছে। রাস্তাঘাট শিশুর খেলনার মতো ভেঙে দিয়েছে প্রকৃতি।”
এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ বিমানে আরও ১০৮ জন যাত্রীর সঙ্গে কলকাতায় পা রেখেছেন সোহন। সরাসরি দেহরাদূন থেকে বিমানটি এসেছে কলকাতায়। বেশির ভাগই বেড়াতে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ পাহাড়ে চড়তে। রাজ্যের পরিকল্পনা ও উন্নয়নমন্ত্রী রচপাল সিংহও ফিরেছেন ওই বিমানে। জানালেন, রাজ্যের ৪০ জন এখনও আটকে আছেন বদ্রীনাথে। ১৪ জন পর্যটকের একটি দলকে (যাঁরা এখনও হাঁটতে সমর্থ) সেনাবাহিনীর সাহায্যে বদ্রীনাথ থেকে রওনা করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হেঁটে গোবিন্দঘাট পর্যন্ত নামলে সেনাবাহিনীর লরি
পেয়ে যাবেন।
এই ৩০ কিলোমিটার পথ যে কতটা বিপদসঙ্কুল, ভাবতে গিয়ে এখনও শিউরে উঠছেন সোহন। |
—নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|