তৃণমূলের সঙ্গে জোট-বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে রাজ্যে ঘর গোছাতে চাইছে কংগ্রেস। লক্ষ্য আগামী লোকসভা নির্বাচন। কিন্তু ঘর গোছানোর সময়েও কংগ্রেসের গলার কাঁটা হয়ে থাকছে ঘরের কোন্দল!
কংগ্রেসের চিরাচরিত গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতিতেও প্রভাব ফেলেছে বলে হাইকম্যান্ডকে জানিয়েছেন দলের প্রদেশ নেতৃত্বই। এআইসিসি-র তরফে সি পি জোশী পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রদেশ কংগ্রেসের তরফে প্রথম যে রিপোর্ট তাঁর কাছে জমা পড়েছে, সেখানেই উঠে এসেছে জেলায় জেলায় অন্তর্দ্বন্দ্বের অভিযোগ!
রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। কিন্তু তার প্রস্তুতির হাল-হকিকত খতিয়ে দেখতে গিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব জেনেছেন, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, হাওড়া, হুগলির মতো কিছু জেলায় দলীয় নেতৃত্বেরই একাংশ তৃণমূলের সঙ্গে ‘গোপন আঁতাঁত’ করে আসন বোঝাপড়া করেছেন। এমনকী, দলের শক্ত ঘাঁটি মালদহেও জেলা নেতৃত্বের ‘নিষ্ক্রিয়তা’য় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে জোশীর কাছে রিপোর্ট দিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস।
চলতি সপ্তাহেই দিল্লিতে জোশীর সঙ্গে দেখা করে রাজ্য কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি-দুর্বলতা, পঞ্চায়েতে দল কত আসনে মনোনয়ন দিতে পেরেছে, তা নিয়ে সবিস্তার রিপোর্ট দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। জোশীর কাছে সরাসরি কোনও নেতার নাম করা হয়নি। তবে কংগ্রেস সূত্রের খবর, কয়েকটি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কার্যকলাপ সম্পর্কেই বিরূপ রিপোর্ট জমা পড়েছে। গোষ্ঠী-দ্বন্দের বিষয়ে বিশেষ মন্তব্য করতে না-চাইলেও প্রদীপবাবু মেনে নিয়েছেন, “দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় মনোনয়ন কিছুটা কম পড়েছে। এটা না-থাকলে এ বার পঞ্চায়েতের প্রস্তুতিটা সামান্য কিছুটা ভাল হত হয়তো! তবে নিজেরা বসে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করব।”
প্রদেশ নেতৃত্ব নির্দিষ্ট কোনও নেতার নাম না-বললেও দলের একাংশের অভিযোগের নিশানায় রয়েছেন বীরভূমে দলের পর্যবেক্ষক ও রাষ্ট্রপতি-পুত্র তথা জঙ্গিপুরের সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। বীরভূমে তাঁর অনিয়মিত যাতায়াত এবং সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধিতে তাঁর গুরুত্ব না দেওয়া এবং তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর ‘সুসম্পর্কে’র জন্যই সেখানে কংগ্রেস পঞ্চায়েতের মনোনয়ন-পর্বে বিশেষ ইতিবাচক কিছু করতে পারেনি বলে অভিযোগ। তবে অভিযোগ নস্যাৎ করে অভিজিৎবাবুর জবাব, “সম্পূর্ণ মিথ্যে অভিযোগ! তবে দল যদি এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে, তখন জবাব দেব। আমাকে এখনও এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলেনি।” তাঁর পাল্টা বক্তব্য, “বোলপুর মহকুমায় তৃণমূলের আক্রমণেই যে আমরা মনোনয়ন দিতে পারিনি, সে কথা তো সকলেই জানেন!”
প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বিধায়ক মানস ভুঁইয়া, তাঁর ঘনিষ্ঠ বাঁকুড়ার পর্যবেক্ষক অজয় ঘোষের বিরুদ্ধেও গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের অভিযোগ কংগ্রেসের অন্দরে। মানসবাবুর প্রতিক্রিয়া, “কারা বলছেন এ সব? সব মিথ্যে! তৃণমূলের হাতে আমরা রক্তাক্ত। তাদের আসন ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না! আসন ছেড়েছি ঝাড়খণ্ড পার্টি, নির্দলকে।” বাঁকুড়ায় আসন-আঁতাঁতের কোনও তথ্য তাঁর জানা নেই বলে দাবি অজয়বাবুরও। দলের বর্তমান প্রদেশ সভাপতির সঙ্গে প্রাক্তনের সম্পর্কের সমীকরণ অবশ্য কংগ্রেসে কারও অজানা নয়! তা ছাড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার মতো জেলার বেশ কিছু অংশে তৃণমূলের সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে গোটা বিরোধী শিবিরেই বিশেষ দ্বিমত নেই। এই প্রেক্ষিতেই জোশীর কাছে অভিযোগের নেপথ্যে গোষ্ঠী-রসায়নেরই খেলা দেখতে পাচ্ছে কংগ্রেসের একাংশ।
হাওড়ার জেলা সভাপতি কাজী আব্দুর রেজ্জাকের সঙ্গে ওই জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনোজ পাণ্ডের ‘অসহযোগিতা’র অভিযোগও দলকে ভাবাচ্ছে। হাওড়া লোকসভার উপনির্বাচনেও তার প্রভাব পড়েছে বলে দলের একাংশের ব্যাখ্যা।
তবে অভিযোগকে গুরুত্ব না-দিয়ে রেজ্জাকের দাবি, “মনোজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালই। অহেতুক কেউ এ সব রটাচ্ছে!”
ঘর গোছাতে গিয়ে কংগ্রেসের ঘর বারবার অগোছালো করে দিচ্ছে বরাবরের সেই কাজিয়া-কাহিনিই! |