আক্ষেপটা ফিরে ফিরে আসে, “কেন জমি আন্দোলনে গেলাম?” পিঠোপিঠি থাকে, “পেলামটাই বা কী?”
জমি-বাঁচানোর জন্য রক্ত আর শান্তি খোওয়ানো মানুষগুলো বদলে গিয়েছেন। আক্ষেপের স্বরই বুঝিয়ে দেয় পরিবর্তনের পরে যেন একই রেখায় দাঁড়িয়ে সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ির শ্যামলী দাস আর নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ার হৈমবতী হালদারদের মতো অনেকে।
|
হতাশার মুখ।
সিঙ্গুরের শ্যামলী দাস। |
সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম। বাম-জমানার সাড়ে তিন দশকের শিকড় উপড়ে দেওয়ার পিছনে খেটে খাওয়া মানুষের জমিরক্ষার যে জোড়া আন্দোলন অনেকটাই দায়ী। কিন্তু ২০০৬-এ জমি আন্দোলনের শুরু থেকে সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি, বাজেমিলিয়ার জমি-যোদ্ধারা যে ভাষায় কথা বলতেন, তা এখন অনেকটাই বদলেছে। ফিকে হয়েছে জমি-রক্ষার জেদ।
সিঙ্গুরের শ্যামলীর এখন আক্ষেপ, ‘‘কেন সে দিন জমি দিলাম না? তা হলে স্বামীকে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গ্রাম ছেড়ে বাইরে যেতে হত না! ছেলেকে মাধ্যমিকের পরে লেখাপড়া ছাড়িয়ে দিতে হয়েছে। ও ছুতোরের কাজ করছে। এখন আমরা গলা জলে দাঁড়িয়ে!’’
একই আফসোস কানে আসে নন্দীগ্রামেও। পেটে আর বুকে সাত-সাতটা গুলির গভীর ক্ষত। ষাট পেরনো হৈমবতী জানালেন, ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ সকালে শরীরে গুলি নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন পুকুরে। বৃদ্ধা বলেন, “এত রক্ত ঝরছিল যে জোর করে ডুবে থাকার শক্তি পাচ্ছিলাম না। গুলির ভয়ে মাথা তোলারও জো ছিল না। জল গিলেছিলাম। কাঁদানে গ্যাসে, ভয়ে চোখের জলও থামেনি।”
থামলেন বৃদ্ধা। খানিক চুপ। তারপরে উগরে দিলেন ক্ষোভের স্রোত। “যাদের গুলি লেগেছিল, তাদের অনেকেই এক লক্ষ করে টাকা পেল। পেলাম না শুধু আমরা। সাত বছর পেরিয়ে গেল। আমাদের কী ভাবে চলে কে খবর রাখে?”
বুকে উঁচু হয়ে রয়েছে বড় মাংসপিণ্ড। ইনস্যাস রাইফেলের গুলিটা ঠিক সেখানেই ঠিকরে হাড় ভেঙে দিয়েছিল। আট মাস পিজি হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে কাটিয়ে বাড়ি ফেরা সোনাচূড়ার অভিজিৎ সামন্ত এখন প্রতিবন্ধী। টেনে-টেনে কোনও মতে জানালেন, চিকিৎসার জন্য মাসে বেশ
কয়েক হাজার টাকা খরচ। বাবার পেনশনের টাকায় সংসার চলে। সংসারে মুখ অনেকগুলো।
তারপরেই হঠাৎ চিৎকার, “কমিটির আন্দোলনে নেমে গুলি খেলাম। সাধারণ কর্মী আমি। আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে অনেকে টাকা পেল, বাদ আমি। কাজ চেয়েও পাইনি। আজ মনে হয়, আন্দোলনে কেন গেলাম?” গুলিচালনার ঘটনায় নন্দীগ্রামে শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রশাসনের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন ১৬১ জন। সাহায্য পাননি ১৯ জন। সরাসরি মুখ না খুললেও হৈমবতী এবং অভিজিতের ক্ষোভের শরিক বলে আনন্দবাজারের কাছে জানিয়েছেন তাঁদের অনেকেই।
ক্ষোভের এই ঝাঁঝ মনে পড়াল সিঙ্গুরের বেড়াবেড়ি, খাসেরভেড়ির এক ঝাঁক মুখকে। জমি আন্দোলন পর্বের নেতা তথা মন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে সিঙ্গুর ব্লক অফিসে ঘিরে রেখে যাঁরা বলেছিলেন, “জমি গেল। রোজগার গেল। জমির জন্য লড়তে গিয়ে শান্তি গেল। সরকারি ভাতা আর চাল যা মেলে, তাতে দিন চলে না। কী করলেন আমাদের জন্য?” |
সোনাচূড়া হয়ে ভাঙাবেড়া সেতু পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার রাস্তা এখন ঝাঁ-চকচকে। সেতুর অদূরে তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর উদ্যোগে ১২২ ফুটের শহিদ মিনারের কাজ প্রায় শেষের মুখে।
স্থানীয় তৃণমূল নেতা আবু তাহেরের সংযোজন, “এলাকায় আটটি নতুন রাস্তা, বড় বাসস্ট্যান্ড হয়েছে। মুক্তমঞ্চ, সোনাচূড়ায় নতুন সেতু হয়েছে। নন্দীগ্রামে হাসপাতাল ঢেলে সাজা হয়েছে। বহু স্কুলে পাকা বাড়ি হয়েছে। আন্দোলন-পর্বের মানুষকে আমরা ভুলে গেলে না এই উন্নয়ন হত, না শহিদ মিনার।”
শুভেন্দু অবশ্য বলেছেন, “হাইকোর্টের নির্দেশে নন্দীগ্রামের কিছু মানুষ টাকা পেয়েছেন। বাম-সরকার আহতদের তালিকা করেছিল। তাতে বাদ যান অনেকেই। হৈমবতীদেবীর ছেলেকে হলদিয়ায় একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া গিয়েছে। সাংসদ হিসেবে পাওয়া বেতন নন্দীগ্রামে গুলিতে যাঁরা আহত হয়েছিলেন তাঁদের চিকিৎসায় খরচ করেছি।” এ পর্যন্ত বলে থামেন সাংসদও। সমস্যা মেনে নিয়ে বলেন, “এটা বাস্তব, ওঁদের জন্য আরও কিছু করতে পারলে ভাল হত। নন্দীগ্রামের আহতদের সংশোধিত তালিকা ফের আদালতে জমা দিয়েছি। শেষ দেখে ছাড়ব।”
কেন যেন মনে পড়ে বেচারাম মান্নাকে। জমির ভবিষ্যত নিয়ে ক্রমশ উৎকণ্ঠা বেড়ে চলা ‘অনিচ্ছুক’ জমিদাতাদের ক্ষোভ প্রশমনে যাঁকে একাধিক বার বলতে শোনা গিয়েছে, “জমি নিয়ে আইনি লড়াইয়ে শেষ দেখে ছাড়ব।” আশ্বাসের এই সুতোও যেন একই মালায় গাঁথে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরকে।
|