চিন্তা ভাবমূর্তি, প্রশাসকে তাই নারাজ মমতা
ভোট নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে আজ, শুক্রবার মেয়াদ ফুরোচ্ছে রাজ্যের সব ক’টি গ্রাম পঞ্চায়েতের। এই ৩৩৪৯টি পঞ্চায়েত এবং পরবর্তী কালে বিভিন্ন পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের মেয়াদ ফুরোলে সেগুলির টাকাকড়ি, হিসেবপত্র গচ্ছিত রাখার জন্য এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম চালানোর জন্য হেফাজত-অফিসার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে বুধবার। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে বিডিও বা তাঁর মনোনীত কোনও ব্যক্তি, পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রে বিডিও নিজে এবং জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে জেলাশাসক বা তাঁর মনোনীত কোনও ব্যক্তি হেফাজত-অফিসার হিসেবে কাজ করবেন। কিন্তু এই অফিসারদের যে হেতু বেতন দেওয়া, বিদ্যুৎ-টেলিফোনের বিল মেটানোর মতো দৈনন্দিন কাজ ছাড়া অন্য খাতে টাকা খরচ করার অধিকার থাকছে না, সে হেতু শনিবার থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে উন্নয়নমূলক কাজের গতি হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মেয়াদ-উত্তীর্ণ পঞ্চায়েতগুলির কাজ কী ভাবে চালানো হবে, তা নিয়ে সরকারি স্তরে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকেই বলছিলেন, মেয়াদ ফুরোনোর আগে পঞ্চায়েত ভোট না-হলে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হবে। থমকে যাবে উন্নয়নের কাজও। পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য বরাবরই সেই আশঙ্কা উড়িয়ে বলে আসছিলেন, তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে প্রশাসক নিয়োগ করে পঞ্চায়েত চালানোর বিধান আইনে আছে। অন্ধ্রপ্রদেশে সে ভাবেই দীর্ঘদিন ধরে পঞ্চায়েত চলছে। প্রশাসক উন্নয়ন প্রকল্প-সহ পঞ্চায়েতের যাবতীয় কাজ করার অধিকারী।
তা হলে কার্যক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসক নিয়োগ করল না কেন?
মহাকরণ সূত্রের খবর, মেয়াদ ফুরোনোর পরে পঞ্চায়েতগুলিতে প্রশাসক বসাতেই চেয়েছিলেন সুব্রতবাবু। কিন্তু বাদ সাধেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে যখন জটিলতা তৈরি হয়েছে, তখন প্রশাসক বসানো হলে সরকারের ভাবমূর্তি ধাক্কা খাবে। এমনিতেই বিরোধীরা প্রচার করছে, সরকার ভোট করতে আগ্রহী নয়। এর পর প্রশাসক বসানোর অর্থ, তাদের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দেওয়া। সরকার পঞ্চায়েতের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, এই প্রচার চালানোর সুযোগ পেয়ে যাবে বিরোধীরা। যা শাসক দলের পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে মোটেই ভাল হবে না।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, প্রশাসক বসিয়ে পঞ্চায়েতগুলির পুরো কর্তৃত্ব না-নিলে, হাজার হাজার কোটি টাকার কেন্দ্রীয় অনুদান খরচ করা যাবে না। আটকে যাবে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে উন্নয়নের ধারা। কিন্তু তাতেও টলানো যায়নি মুখ্যমন্ত্রীকে। তার পরই এক প্রকার বাধ্য হয়েই গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে হেফাজত-অফিসার রাখার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে পঞ্চায়েত দফতর।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতানৈক্যের খবর অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন সুব্রতবাবু। তিনি বলেন, “কাস্টডিয়ান বা হেফাজত-অফিসার বসানোর যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটাই সরকারি সিদ্ধান্ত। কী ভাবনা ছিল, তা এখন মনে নেই। তা ছাড়া, কোনও ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এটাই স্বাভাবিক। মতানৈক্যের মনগড়া গল্প আসছে কী করে?”
পঞ্চায়েত দফতর সূত্রের খবর, মেয়াদ-ফুুরোনো পঞ্চায়েতগুলি নিয়ে কী করা হবে, সে ব্যাপারে মাসখানেক আগেই চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। পঞ্চায়েত দফতরের প্রস্তাব ছিল, প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে এক জন করে প্রশাসক বসানো হবে। ঠিক হয়, ব্লকস্তরের এক্সটেনশন অফিসারকে (এঁরা গ্রুপ-বি ক্যাডারের, মিসলেনিয়াস সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে ঢোকেন) এক একটি পঞ্চায়েতের দায়িত্ব দেওয়া হবে। দফতরের প্রস্তাবে বলা হয়, একটি ব্লকে গড়ে ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত থাকে, একই ভাবে ৮-১০ জন করে এক্সটেনশন অফিসারও ব্লকে কমর্রত থাকে। এঁদের প্রশাসক নিয়োগ করলে সহজেই পঞ্চায়েতগুলি চালানো সম্ভব হবে। পঞ্চায়েত আইনে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে প্রশাসক বসানোর ব্যবস্থা থাকায় এঁরা কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির কাজও চালাতে পারবেন।
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে মামলা চলায় এই প্রস্তাবটি সম্পর্কে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) বিমল চট্টোপাধ্যায়ের মতামত চান সুব্রতবাবু। এজি আলোচনার জন্য পঞ্চায়েতমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে ডেকে পাঠান। সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করার বদলে অর্ডিন্যান্স করে প্রশাসক বসানোর বিষয়টিও আলোচনায় ওঠে। কিন্তু পঞ্চায়েত দফতরের কর্তাদের বক্তব্য ছিল, এমনটা হলে বিরোধীরা প্রচারের হাতিয়ার পেয়ে যাবে। তারা বলতে পারে পাকাপাকি ভাবে প্রশাসক বসাতেই অর্ডিন্যান্স করা হচ্ছে। হাইকোর্ট ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে ভোট শেষ করার কথা বলেছে। ফলে জুনে মেয়াদ শেষ হওয়া পঞ্চায়েতে প্রশাসক না-বসিয়ে উপায় নেই। এটা একটা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা। কেউ এ নিয়ে আদালতে গেলে সরকারের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
পঞ্চায়েত দফতরের এই মত সকলেই মেনে নেন। ঠিক হয়, জুন মাসের শেষ সপ্তাহে প্রশাসক বসানোর নির্দেশ জারি করে দেওয়া হবে।
দফতরের এক কর্তা জানান, এর পর হঠাৎই এক দিন মুখ্যমন্ত্রী এ নিয়ে খোঁজ নেন। ডেকে পাঠান পঞ্চায়েতমন্ত্রীকে। মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রও বৈঠকে ছিলেন। প্রশাসক বসানোর কথা শুনে বেঁকে বসেনমুখ্যমন্ত্রী। ভাবমূর্তির প্রশ্ন তুলে জানিয়ে দেন, প্রশাসক বসালে তাঁকে গণতন্ত্র-বিরোধী বলে প্রচার করার সুযোগ পেয়ে যাবে বিরোধীরা। তারা বলবে, প্রশাসক বসিয়ে ঘুরপথে পঞ্চায়েত দখল করতেই ভোট নিয়ে টালবাহানা করেছেন তিনি। তৃণমূল যে ভোট করতে চায়, সেই বিষয়টাই পিছনে চলে যাবে।
কেউ কেউ মুখ্যমন্ত্রীকে বলার চেষ্টা করেন, প্রশাসক না-বসালে উন্নয়নের কাজকর্ম শিকেয় উঠবে। এমনিতেই আচরণবিধি চালু হয়ে যাওয়ায় প্রায় তিন মাস সব কাজ বন্ধ। চলতি দিনক্ষণ মেনে ভোট হলেও ১৫ জুলাইয়ের পর গ্রামসভার বৈঠক করে পঞ্চায়েত গঠন করতে আরও বেশ কিছু দিন লাগবে। ফলে নতুন বোর্ড যত দিন না গঠন হচ্ছে, তত দিন প্রশাসক দিয়ে কাজ চালালে ক্ষতি কী? কিন্তু কোনও মতেই মুখ্যমন্ত্রীকে রাজি করানো যায়নি। ফলে আপাতত হেফাজত-অফিসার দিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির সলতে টিমটিম করে জ্বালিয়ে রাখা ছাড়া অন্য উপায় নেই, বলছেন পঞ্চায়েত-কর্তারা।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.