পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার চলাকালীন বারুইপুরে তৃণমূল নেতা খুনের মামলায় নাম জড়াল সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর। বারুইপুর থানায় নিহতের ভাই যে পাঁচ জনের নামে এফআইআর দায়ের করেছেন, তার মধ্যে সুজনবাবুর নামও আছে। সিপিএম অবশ্য এই অভিযোগের পিছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে দায়ী করে সরকার ও শাসকদলকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
বারুইপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ, স্থানীয় তৃণমূল নেতা শিবরাম হালদার তথা শ্রীদাম (৪২) বুধবার দুপুরে ধারালো অস্ত্রের কোপে গুরুতর জখম হন। হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রাথমিক তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, গোলমাল হয়েছিল মদের আসরে। ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে শিবরামবাবুরই এক সহযোগী তাঁকে খুন করেছে বলে জেলা পুলিশের একাংশের বক্তব্য। নিহতের এক সহযোগীকে গ্রেফতার এবং এক জনকে আটকও করা হয়েছে। এরই মধ্যে সুজনবাবুর নামে অভিযোগ দায়ের করেছেন নিহতের ভাই। তবে বৃহস্পতিবার সুজনবাবুকে অবশ্য গ্রেফতার করার চেষ্টা করেনি পুলিশ। এ দিন দিনভর তিনি আলিমুদ্দিনে দলের সদর দফতরে ছিলেন। সন্ধ্যায় একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দফতরেও যান। |
শিবরামবাবুর ভাই সুজনবাবুর নামে অভিযোগ করলেও তাঁর মেয়ে সুপ্রীতি হত্যাকারী হিসেবে যার নাম বলছেন, সেই কানু সাঁপুই এলাকায় তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলেই পরিচিত। সুপ্রীতির কথায়, “সে দিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ কানুর বাড়ির পাশের এক প্রতিবেশী যুবক এসে আমাদের জানায়, বাবার গলা কেটে দেওয়া হয়েছে। আমরা কানুর বাড়িতে ছুটে যাই। মাদুরে মোড়া অবস্থায় বাবা আমার হাতে তাঁর মোবাইল ফোনটি দিয়ে বলেন, ‘কানু আমাকে মেরেছে।’ তার পরেই বেহুঁশ হয়ে যান।”
সুপ্রীতির অভিযোগ, কানু পরিকল্পনা করেই তাঁর বাবাকে খুন করেছে। বছরখানেক আগেও শিবরামকে এক বার মারধর করে পুকুরে ফেলে দিয়েছিল কানু। তা হলে শিবরামবাবুর পরিবার থেকেই সুজনবাবুর নামে এফআইআর (সেখানে কানুর নামও আছে এবং সে পলাতক) হল কেন? সুপ্রীতির বক্তব্য, “আমি ওই বিষয়ে কিছু জানি না। ওটা রাজনীতির বিষয় হবে হয়তো!”
এই অবস্থায় শাসক দল সুজনবাবুকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের তরফে গৌতম দেব বৃহস্পতিবার রাতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, মহাকরণ থেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চলতে থাকলে বাম কর্মী-সমর্থকদের খুনের ঘটনায় তৃণমূলের শীর্ষ নেতা মুকুল রায়ের নামে অভিযোগ দায়ের করবেন তাঁরা। এমনকী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামেও উস্কানির অভিযোগ আনতে তাঁরা বাধ্য হবেন! পুলিশ সেই অভিযোগ নিতে চাইবে না ধরে নিয়েই আদালত থেকে তাঁরা নির্দেশ নিয়ে আসবেন বলে জানান গৌতমবাবু।
অন্য দিকে, এ দিন নিহত শিবরামবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “সিপিএম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে চাইছে না। সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে।” ওই খুনের ঘটনায় সুজনবাবুর জড়িত থাকার প্রশ্নে পার্থবাবুর জবাব, “পুলিশ তদন্ত করছে। আরও অনেক বড় নেতা জড়িত থাকতে পারে!” ময়নাতদন্তের পরে এ দিনই শিবরামবাবুর মৃতদেহ বারুইপুর পঞ্চায়েত সমিতি দফতর ও বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে ছিলেন কলকাতা পুরসভার মেয়র তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান শোভন চট্টোপাধ্যায় ও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি করে ফিরহাদও বলেছেন, “সিপিএম ৩৪ বছরের অভ্যাস ভুলতে পারেনি! এখনও খুন করে চলেছে!” সুজনবাবু কি খুনে জড়িত? পুরমন্ত্রীর বক্তব্য, “পুলিশ তদন্ত করছে।” সুজনবাবু এ দিন বলেন, “নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কেউ খুন হলে তৃণমূলের নেতাদের তো লজ্জায় মুখ ঢাকা উচিত! তাঁরা উল্টে বিরোধীদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন!” তাঁর আরও অভিযোগ, “বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যকান্ত মিশ্র, গৌতম দেবদের ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে। সেই তালিকায় আমার নাম যুক্ত হয়েছে! সারদা কাণ্ডে জড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল। এ বার খুনের মামলা!” প্রাথমিক ভাবে সিপিএম ঠিক করেছে, জামিনের জন্য আগাম আবেদন জানানো হবে না। বরং সুজনবাবুকে গ্রেফতার করা হলে তারা প্রচার করবে, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে মিথ্যা মামলায় বিরোধীদের হেনস্থা করছে সরকার! সুজনবাবুর কথায়, “সারা রাজ্যে আমাদের এত নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমি গ্রেফতার হলে আর কী হবে?”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যেরও অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল সরকার বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করছে। তাঁর বক্তব্য, “যে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাকে গ্রেফতারের বা পুলিশি হেনস্থায় আমরা শঙ্কিত। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে অশনি সঙ্কেত!”
কয়েক দিন আগেই আবাসন-দুর্নীতির অভিযোগে সিআইডি-র জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছিল প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতমবাবুকে। আলিমুদ্দিনে এ দিন সুজনবাবুকে পাশে নিয়ে সেই গৌতমবাবুই বলেন, “এটা নোংরা রাজনীতি! পুলিশ অফিসারদের কেউ কেউ বার বার বলেছেন, সুজনের নাম ঢোকানো যায় না! কিন্তু তাঁদের মাথার উপরে কেউ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যে, সুজনের নাম ঢোকাতেই হবে!” গৌতমবাবুর জিজ্ঞাসাবাদের দিন সিপিএম ভবানী ভবনের বাইরে জমায়েত করেছিল। সুজনবাবুকে গ্রেফতার করা হলেও পথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে তারা। গৌতমবাবুর হুঁশিয়ারি, “সুজনকে নিয়ে কোনও রকম অসভ্যতা হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ হবে! আমাদের তিনটি জেলা (দুই ২৪ পরগনা ও কলকাতা) বসে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
গৌতমবাবুর এই হুঁশিয়ারির জবাবে মুকুলবাবু বলেছেন, “কোনও মন্তব্য করব না! শুধু ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব, উনি দ্রুত সুস্থ হোন! ওঁর সুদীর্ঘ জীবন হোক!” |