বাবা জ্ঞান দিয়ো না
প্রাণের কথা নম্বরে
ফেসবুকের ওপেন স্পেসে গোপন টক। ছবি নয়, নাম নয়, নম্বর নিয়ে মন খোলার খেলায় মেতেছে ফেসবুকিরা। যে বন্ধুর সঙ্গে মন চাইবে সব ধরনের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে, তার ফেসবুকের মেসেজ বক্সে কেবল একটা নম্বর পৌঁছে দিতে হবে। সেই নম্বরই তখন আপনার পরিচয়। এই নম্বর কেবলমাত্র দুই বন্ধুর মধ্যেই থাকবে। ব্যস! অপর বন্ধু তারই স্টেটাসে লিখে চলবেন সেই নামহীন নম্বর সম্পর্কে না বলা সব কথা। সত্যজিতের ‘শাখা প্রশাখা’র সেই এক-নম্বরি দু’নম্বরি নিয়ে ভাল-মন্দের বিচার করার দিন আর নেই। বরং নম্বরের এই গোপন নেশায় ছাত্র, শিক্ষক, অচেনা নারী-পুরুষ, অভিভাবক- সন্তান, আত্মীয়- অনাত্মীয় সমাজের সব স্তরই মত্ত। সম্পর্ককে নতুন করে পাওয়ার ধুম লেগেছে হৃদ্কমলে।
এই সামনে থেকে লুকিয়ে বলায় কী নেই? ব্যঞ্জনা থেকে বেদনা, সবই জড়ো হচ্ছে ফেসবুকের লম্বা লম্বা স্টেটাস মেসেজে। কেমন সেই বন্ধু? বা তাঁর জীবনে সেই বন্ধুর জায়গা কতটা? কোন ঘটনায় কখন কেউ আঘাত পেল? বাদ পড়ে না তাঁর প্রেম বা যৌনতার নানান খুল্লমখুল্লা চর্চা। এর মধ্যে জড়িয়ে এক ধরনের প্রত্যাশা। নিজেকে অন্যের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা। প্রচ্ছন্ন আছে আনন্দ আর উত্তেজনা। নম্বরের আসল পরিচয় কেউ জানবে না। অথচ তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা যাবে, জানা যাবে। তৈরি হবে অন্যের কৌতূহল আর কথার ধাঁধার খেলা।
আসলে আমার আমিকে বারেবারে, ফিরেফিরে জানতে চাওয়ার তাগিদেই ক্রমশ জনপ্রিয় এই জগঝম্পের খেলা। “পাশের মানুষ কাছে থাকার চেয়ে দূরের মানুষ আজ সহজে কাছে আসে। সেই দূরের মানুষের সঙ্গে পরিচয় না হয় হল, কিন্তু আলাপ? কেমন করে সে দেখছে আমায়? খুব জানতে ইচ্ছে করল।
এই ইচ্ছে থেকেই ‘#৪৬’ এই নম্বরটা অরিত্রর মেসেজ বক্সে পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকেই মুগ্ধতার বিস্তার। অরিত্র ওর স্টেটাস বক্সে ‘#৪৬’-কে নিয়ে লিখতে লাগল নানান কথা। কখনও চাপা স্বরের সমালোচনার সুর, কখনও আমার শাড়ির কথা, হাতে চক ধরার ধরনের ভঙ্গি। সারা রাতের ঘন ঘন স্টেটাস আপডেটের পাগলামিতে ভরে উঠল আমার ফেসবুকের নোটিফিকেশনের পাতা। অদ্ভুত লাগত ভাবতে, খুব পরিচিত নয় এমন এক মানুষের ফেসবুকের স্টেটাসে কেবল আমার কথা!” এ ভাবেই নতুন উত্তেজনায় মেতেছেন অনন্যা। মধ্যবয়সী স্কুল-শিক্ষিকা অনন্যা আর অরিত্র একই স্কুলে পড়ান। স্কুলে কাজের সূত্রেই কোনও কেজো কথা চালাচালি করা ছাড়া আর কোনও যোগাযোগ তাঁদের ছিল না। আজও নেই। কিন্তু ফেসবুকের এই নম্বরের ঘূর্ণিফাঁদে নতুন ভাবে ধরা দিয়েছেন দু’জনে। ‘কখনও ভাবিনি গম্ভীর, বই-সর্বস্ব এই সংসারী ভদ্রলোক এত রসিক’! রোমাঞ্চিত ‘#৪৬’, ওরফে অনন্যা।
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- ইদানীংকালে কথা বলা, আড্ডার স্পেসের তো অভাব নেই। তবে এই খেলার এত জনপ্রিয়তা কেন?
“আসলে গোপনীয়তার প্রতি আকর্ষণ আমাদের চিরকালের। গোপনীয়তাকে ঘিরে যে উত্তেজনা, আনন্দ আমাদের মাতিয়ে রাখে সেই উচ্ছ্বাস, উদ্দামের আনন্দই মানুষ এই ফেসবুকের খেলায় ফিরে পাচ্ছে। ফেসবুকের মেসেজ বক্সে কেউ সরাসরি কারও সম্বন্ধে লিখে জানালে তেমন করে নতুন কোনও মজা হত না, যা আর পাঁচটা অন্য মানুষের সামনে খোলাখুলি অথচ গোপন করে প্রকাশ করার মধ্যে আছে।”
গোপনীয়তার ফাঁদে ঘুরছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও। ‘কনফেশন’ বক্স কাউন্সেলিংয়েরও কাজ করছে ফেসবুকের এই ছদ্ম নম্বর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নীলাঞ্জনার কাছে এই নিয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, “এই খেলার মধ্যে দিয়ে নিজের ভুল বা কনফিউশনগুলোকে আমার প্রিয় শিক্ষকবন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করে হালকা হয়েছি। ওঁকে ক্লাসরুমে বা ক্যান্টিনে দেখা হলে যা বলতে পারছিলাম না, এই নম্বরের মাধ্যমে তা জানাতে পেরেছি। জানতেও পেরেছি আমার সমস্যা কোথায় কোথায় ছিল? তা কতটা মনগড়া। খানিকটা কাউন্সেলিংয়ের কাজ করেছে আমার জীবনে এই নম্বরি নেশা।’’
নিজের কথা শুনতে, নিজের সম্পর্কে জানতে কার না ভাল লাগে? ‘‘আমি কিছু ক্ষণের জন্য হলেও অন্য আর এক মানুষের ভাবনার অংশ জুড়ে আছি এই ভাবনার মাঝে এক ধরনের তৃপ্তি আছে। এই তৃপ্তির জন্যই আমি এই গোপন খেলার নেশা করেছি,’’ জানালেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী সুরঞ্জন রায়। বাদ নেই তৃতীয় বর্ষের বি.কমের ছাত্র অর্কপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্ধুর মতামত জানার জন্য, নিজের প্রশংসা শোনার জন্যই নিজেকে ৫২৩ নম্বর দিয়ে বন্ধুদের মেসেজ বক্সে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ? “সব সময় হ্যাপেনিং কিছু চাই আমার,” উত্তরে জানালেন তিনি। আজকের সমাজের বদলে যাওয়া জীবনের ছায়াই ধরা দিচ্ছে ফেসবুকের এই নতুন খেলায়। মানুষ ক্রমশ ইনফর্মাল হয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে সমন্বয়ের স্তর, সংযোগের ভাষা। কইতে কী চাই কইতে কথা বাঁধের দিন শেষ। পরানের কান্নাকাটিও দূর অস্ত। কফিশপের বর্ণিল ধোঁয়ার পরিবেশ, সন্ধ্যারাত্রির ঝিম আড্ডা যা পারেনি, ফেসবুক তাই পারছে। ঘুম ছোটা, বাঁধ ভাঙনের এই নম্বর খেলা খুলে দিচ্ছে জেন ওয়াই থেকে ওল্ড ফ্যাশনের ভদ্রসমাজের মনের প্রান্তর।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.