শুকিয়ে যাওয়া কোষাগার বাঁচাতে রাজ্যে প্রবেশ কর ফিরিয়ে এনেছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। সোমবার তাঁর সেই সিদ্ধান্তকে খারিজ করে দিল হাইকোর্ট। বিচারপতি ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, রাজ্যের প্রবেশ কর আইনটি অসাংবিধানিক।
শিল্পমহল স্বস্তি পেলেও এই রায়ের জেরে এমনিতেই বেহাল রাজ্যের অর্থনীতি আরও দুর্দশার মধ্যে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, চলতি আর্থিক বছরে প্রবেশ কর থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আয়ের আশা করছিলেন অর্থমন্ত্রী। রাজ্য অবশ্য এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে অথবা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে কোষাগারের দুর্দশার কথা বারবার বললেও করের হার বৃদ্ধি বা জনগণের উপরে নতুন কর বসানোর ব্যাপারে সায় দেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পরিস্থিতিতে আয়ের নতুন উৎস খুঁজতে ২০১২-১৩ সালের বাজেটে প্রবেশ কর আরোপ করার কথা ঘোষণা করেন অমিতবাবু। অন্য রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও পণ্যের প্রবেশ এবং রাজ্যের মধ্যেও এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পণ্য যাতায়াতের উপর ১ শতাংশ হারে কর বসানো হয়। সরাসরি জনগণের উপরে না-বসানোয় এই কর নিয়ে আপত্তি করেননি মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু আপত্তি তুলেছিল শিল্পমহল। হাইকোর্টে টাটা স্টিল-সহ ১৮টি সংস্থা যে মামলা করে তাতে বলা হয়, যে রাজ্যে পণ্য তৈরি হয় সেখানে এক দফা কর দিতে হয়। সেই একই পণ্য আবার যখন অন্য রাজ্যে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা হয় সেখানে বিক্রয় কর দিতে হয়। তার উপর প্রবেশ কর বসলে আখেরে জিনিসের দাম বাড়বে। যার ফল ভুগবেন সাধারণ মানুষই। তা ছাড়া, এই পণ্য প্রবেশ কর বিল বিধানসভায় পেশের আগে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেছিল সংস্থাগুলি।
সরকার পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলে, প্রবেশ করের টাকা সম্পূর্ণ ভাবে পথ-ঘাট উন্নয়নের কাজেই ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ, পণ্য প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি উন্নত পরিকাঠামো এবং পরিষেবা যাতে পেতে পারে সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই প্রবেশ কর চালু করা হয়েছে। আর সংবিধানের ৫২ নম্বর ধারায় রাজ্যের তালিকাভুক্ত বিষয়ে যে হেতু কর আরোপ করা হয়েছে, সে হেতু রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন নেই বলেও দাবি করে রাজ্য।
অমিতবাবু এ দিন বলেন, “আমরা আদালতে যুক্তি দিয়েছিলাম এই কর আদায় করে ব্যবসার পরিকাঠামো তৈরি, ব্যবসায়িক উন্নতিতেই খরচ করা হবে। এই করের অর্থ বেতন বা সেই জাতীয় কোনও কাজে খরচ করা হয় না। আমাদের বাজেটেও তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সেই জন্যই এটাকে ‘কম্পেনসেটরি ট্যাক্স’ বলা হয়। কিন্তু বিচারপতি এই যুক্তি মানেননি।” এই অবস্থায় রাজ্য কী করবে? অর্থমন্ত্রীর কথায়, “মাথায় রাখতে হবে এটা সিঙ্গল বেঞ্চের রায়। ছ’সপ্তাহ সময় রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, অসম-সহ ১৫টি রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে। আদালতের নির্দেশ হাতে পেলে পরিষ্কার হবে, কী কারণে এই রায়। আমরা তার পরে সিদ্ধান্ত নেব।”
প্রবেশ-কর বিতর্কের অবসানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইতিমধ্যে ৯ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। এ নিয়ে আগেও বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিম কোর্টে সাংবিধানিক স্পেশ্যাল বেঞ্চ বসেছে। প্রথম বার তিন বিচারপতির বেঞ্চ, তার পরে পাঁচ, শেষে সাত বিচারপতির বেঞ্চ তৈরি হয়। সব বেঞ্চের রায়ই প্রবেশ করের বিরুদ্ধে গিয়েছে। সাত বিচারপতির স্পেশ্যাল বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছিল, রাজ্য সরকার পণ্য থেকে পথ-কর জাতীয় কিছু আদায় করতে পারে ঠিকই, তবে সে টাকা রাস্তা-সেতু ইত্যাদি পরিকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নেই খরচ করতে হবে। অন্য খাতে নয়। (প্রবেশ কর এই খাতে ব্যয় হয় বলেই যুক্তি দিয়েছে রাজ্য।)
আইনি লড়াই আরও দীর্ঘ হবে জানা থাকলেও এ দিনের রায়ে তাদের নৈতিক জয়ই দেখছে শিল্পমহল। আদালতে যাওয়ার আগে সিআইআই, ফিকি-সহ প্রায় সব বণিকসভাই এই কর প্রত্যাহারের জন্য রাজ্যের কাছে বারবার দরবার করেছে। শিল্পমহলের যুক্তি, প্রবেশ করের জন্য রাজ্যের উৎপাদন শিল্প প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে কাঁচা মাল আমদানি করতে হয়। তার উপর প্রবেশ কর বসায় বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদনের খরচ। ফলে পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে সংস্থাগুলি। কিন্তু অন্য রাজ্যের সংস্থাদের জিনিসের দাম তুলনায় কম থাকছে।
শিল্প সংস্থাগুলির আরও বক্তব্য, সংবিধান সারা দেশে অবাধ বাণিজ্যের যে অধিকার দিয়েছে, পণ্যে প্রবেশ কর বসিয়ে তাতে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। শিল্পমহলের একাংশের মতে, প্রবেশ করের সুবাদে রুগ্ণ হলদিয়া পেট্রোকেম চাঙ্গা করার উদ্যোগেও বিঘ্ন ঘটেছে। কারণ, সংস্থাটি বাইরে থেকে যে ন্যাপথা নিয়ে আসে, তা প্রবেশ করের আওতায়। তারা জানাচ্ছে, গুজরাতেও প্রবেশ কর রয়েছে। কিন্তু কাঁচা মাল আমদানির উপর কর ছাড় দিয়েছে সে রাজ্যের সরকার। একই ভাবে, স্থানীয় উৎপাদন শিল্পকে প্রবেশ কর ছাড় দিয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার। কিন্তু শিল্পমহলের এই সব যুক্তি রাজ্য সরকার মানেনি।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, প্রবেশ কর আঁকড়ে থাকার মূল কারণ, এই খাতে প্রত্যাশা ছাপিয়ে আয়। ২০১২-১৩ সালের বাজেটে প্রবেশ কর চালু করার সময় এই খাতে মাত্র ৬ লক্ষ টাকা আয় হবে বলে ধরেছিলেন অমিতবাবু। কিন্তু সেই আর্থিক বছরের শেষে সংশোধিত প্রস্তাবে তিনি জানান প্রবেশ কর থেকে আয় হবে ১২৫০ কোটি টাকা। সে বার মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে যাওয়ার পিছনে প্রবেশ কর থেকে এই বিপুল আয়ের অবদান অনেকটাই। ২০১৩-১৪-র বাজেটে এই খাতে ১৪৩৭ কোটি টাকা আয়ের আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ দফতরের সূত্রের খবর, যে হারে প্রবেশ কর আদায় হচ্ছিল, তাতে চলতি অর্থবর্ষে ওই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনো সম্ভব হতো।
ঘটনা হল, বাম আমলেও একটা সময় রাজ্যে প্রবেশ কর চালু ছিল। কিন্তু আদায়ের ক্ষেত্রে নানা বেনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়ার পরে ওই কর তুলে দেওয়া হয়।
আদালতের এ দিনের রায়ের পরেও অবশ্য এখনই প্রবেশ কর আদায় বন্ধ হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন অর্থ দফতরের কর্তারা।
|
ধাক্কা প্রবেশ করে |
রাজ্যের পণ্য প্রবেশ কর আইনটি অসাংবিধানিক।
কলকাতা হাইকোর্ট |
এটা সিঙ্গল বেঞ্চের রায়। ১৫টি রাজ্য ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। নির্দেশ হাতে পেলেই সিদ্ধান্ত।
অমিত মিত্র অর্থমন্ত্রী |
২০১২-’১৩ আর্থিক বছরে পণ্য প্রবেশ কর থেকে আয় ১,২৫০ কোটি। ধরা হয়েছিল মাত্র ৬ লক্ষ টাকা। |
২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে এই খাতে ১,৪৩৭ কোটি আয়ের প্রস্তাব রয়েছে। |
|