প্রবন্ধ ২...
নাগরিক সমাজও দলীয় রাজনীতিতে জড়াবে?
কামদুনির প্রতিবাদে তো আকাশ ফাটাচ্ছেন, নন্দীগ্রামে হার্মাদদের আক্রমণের সময়, সিঙ্গুরে তাপসী মালিকের সময়, বা বানতলায় অনিতা দেওয়ানদের ওপর অত্যাচার, খুনের সময় কোথায় ছিলেন?’ এর পালটা: ‘নন্দীগ্রামের সময় তো খুব কপচেছিলেন, মহামিছিল করেছিলেন, এখন পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া বা কামদুনির সময় মুখ লুকিয়ে আছেন কেন?’ এমত জগঝম্প চর্চায় এখন বঙ্গভূমির আকাশবাতাস মুখরিত। চায়ের দোকান থেকে কর্মক্ষেত্র, ট্রাম-বাস-ট্রেন বা সান্ধ্য টিভি, এক কথায় বাঙালির জনপরিসরের সব অংশটুকু জুড়ে চলেছে এই কথা-পালটা কথার প্রবাহ, বা প্রতিবাদের ‘আমরা-ওরা’ নিয়ে এক মহাচর্চা।
চর্চার উদ্দিষ্টরা হলেন সমাজের সেই অংশ, যাঁরা ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘সুশীল সমাজ’, ‘নাগরিক সমাজ’, ‘বিদ্বজ্জন’, ‘বিশিষ্ট’ ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সময় থেকে যাঁদের ‘স্বাধীন’ (অনেকটা অ-দলীয়) প্রতিবাদে বাংলার শিক্ষিত মানুষের একটা বড় অংশ বিগত সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। মাত্র ছ’বছরের মধ্যে সেই নাগরিক সমাজের প্রতি এবং তার নিজের মধ্যে ঠিক দলীয় রাজনীতির ঢঙে যে ভাবে ‘আমরা-ওরা’র আকচাআকচি চলছে, তাতে বোঝা যায়, এখনও এই পোড়া বাংলায় দলই স্বর্গ, দলই ধর্ম, দলই পরমং তপঃ।
এই পর্যন্ত পড়ে অনেকে ভাবতে পারেন, এ হল রাজনীতি-বিমুখতা, বা অ-রাজনীতির পক্ষে কোনও নতুন সওয়াল। আদৌ তা নয়। আসলে এমনটা যাঁরা ভাবেন বা ভেবে অভ্যস্ত, তাঁরা ‘রাজনীতি’ ও ‘দলীয়তা’কে সমার্থক ভাবেন, বা ‘দলীয় রাজনীতি’কেই রাজনীতির একমাত্র রূপ বলে ধরে নেন। তাঁরা ভুলে যান যে ‘রাজনীতি’ কথাটির পরিব্যাপ্তি অনেক বড়। জীবনের পরতে পরতে— ব্যক্তিগত, পারিবারিক থেকে সামাজিক, কর্মক্ষেত্রীয়, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রেই তা কবচকুণ্ডলের মতো আমাদের জড়িয়ে আছে। সোজা কথায়, জীবনের প্রতিটি স্তরেই আছে ক্ষমতার অস্তিত্ব ও তা প্রয়োগের সংগঠন এবং কৃৎকৌশল। জীবনের বহুস্তরী ক্ষমতা-রা আমাদের কাজকর্ম, আচরণ (এমনকী চিন্তাভাবনা) অনুমোদন বা অননুমোদন করে, তাদের প্রয়োজন মতো আমাদের গড়েপিটে অনুগত বানাতে চায়। বহু ক্ষেত্রে আমরা তার অধীন, আবার অনেক সময়েই আমাদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সে ‘অন্যদের’ অধীন করে। জ্ঞানচক্ষু মেলার পর থেকেই এই ক্ষমতা-বলয়গুলির সঙ্গে প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া, আপস, ফস্টিনস্টি, ঝগড়াঝাটি এমনকী সংগ্রাম করে আমাদের জীবন কেটে যায়।
ফলে, ‘দৈনন্দিনের রাজনীতি’ আমাদের জীবনের অঙ্গ। প্রতি দিনের ছোট ছোট প্রতিবাদ বা সমাজ-পরিবেশের সার্বিক প্রশ্ন— সবটাই, বড় অর্থে, ‘রাজনীতি’র বিষয়। যখন মানবাধিকার বা সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা পুলিশি হেপাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে বা তথ্যের অধিকার, খাদ্য সুরক্ষার মতো বিষয় নিয়ে পথে নামেন, যখন লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে, বা বিকল্প যৌনতার পক্ষে মানুষ সরব হয়, তখন সেটা অবশ্যই রাজনীতি। ঠিক একই ভাবে, নানা ভঙ্গিতে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ জ্ঞাপনও রাজনীতিই। কিন্তু ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ হল দলীয় রাজনীতি। অনেকে বলেন, উত্তর বা মধ্য ভারতের মতো ‘জাতপাতের রাজনীতি’ বাংলায় নেই। কিন্তু দলীয় রাজনীতির ‘ভিতর দিয়ে’ই যখন বাঙালির ভুবনখানি দেখা হয়, তখন দলগুলিই হয়ে ওঠে এক নতুন জাতপাত ব্যবস্থা। তখন কার জল ‘চল’ বা ‘অচল’, কার বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেব, বা কাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করব, কাদের চার দিক থেকে ঘিরে রেখে ‘লাইফ হেল’ করে দেব, কাকেই বা ‘সাপের মতো’ পিটিয়ে মারব এই সব নিয়ে, ঠিক জাতপাতের রাজনীতির ঢঙেই চর্চা ও প্রয়োগ চলতে থাকে, তখন যুক্তি অস্ত যায়। ঠিক যে ভাবে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান ক্লাবের সমর্থকরা কোনও যুক্তিকে ভিত্তি করে নয়, আবেগে ও (সাধারণত) বংশপরম্পরায়— তাদের পছন্দের ক্লাবকে সমর্থন করে যায়, তেমনই বাংলার দলীয় রাজনীতিতে মানুষের (বিশেষত গ্রামাঞ্চল ও মফস্সলে) গায়ে আঁতুড় থেকে শ্মশান পর্যন্ত পার্টির পরিচয় দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু, সমাজ বা রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, বিবেকী নাগরিক সমাজ এই দলীয় কলুষের আবর্তে জড়িয়ে পড়বে কেন, এই বিশ্বায়ন-উত্তর অবাধ যোগাযোগের সাম্প্রতিক যুগে?
যোগাযোগ প্রযুক্তির মহাবিপ্লবে আজ ‘ঘুচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি’। ফলে, নগরকেন্দ্রিক গণপরিসরের ধারণাও (যেমন, প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে জন-সংলাপময় মার্কেট-চত্বর বা ‘অ্যাগোরা’, কিংবা আধুনিক কালের কফি হাউস) আরও ব্যাপ্তি পেয়েছে। হাতে একটা মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটের সুবিধাযুক্ত কম্পিউটার থাকলে মতবিনিময় বা তথ্য আদানপ্রদান করার জন্য ফি-বিকেলে কফি হাউসে হাজিরা দেওয়ার দরকার নেই বিশ্বের যে-কোনও প্রান্ত থেকেই তা করা সম্ভব। নতুন প্রযুক্তির পথ বেয়ে তৈরি হয়েছে কতশত মতামত, বন্ধুতার গোষ্ঠী বা কমিউনিটি। বহু পত্রপত্রিকা (তার মধ্যে বাংলা সাহিত্যপত্রও আছে) আজকাল ছেপে বেরোয় না, ‘নেট’-এ বেরোয়। এ কথা ঠিক, তথ্যপ্রযুক্তি একটু দু’ধার-বিশিষ্ট তলোয়ার। একটা ‘ধার’ দিয়ে ক্ষমতাবান বা রাষ্ট্র সবার উপর নজরদারি চালাতে পারে; ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু অন্য ‘ধার’টি কাজে লাগতে পারে ক্ষমতাবানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সংগঠনের কাজেও, রাষ্ট্র কখনওই তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তখন দমিত, প্রান্তিকের স্বরও মুহূর্তে প্রতিবাদের কেন্দ্রে উঠে আসতে পারে, যুক্ত করতে পারে অযুত-লক্ষ মানুষকে। তখন ‘নাগরিক সমাজ’ ও ‘নেট’-ব্যবহারকারী নাগরিকরা, বা ‘নেটিজেন’রা (যারা সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান) মিলে যায়। বড় গণমাধ্যমও (বিশেষত, চরম প্রতিযোগিতাময় বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম) এই প্রতিবাদকে অবজ্ঞা করতে পারে না। ক্রমে সাধারণ জনসমাজ তাতে যোগ দেয়। তখন প্রতিবাদের জনজোয়ার ক্ষমতার সাঁকো নাড়িয়ে দিতে পারে।
নাগরিক জনপরিসরের এই ক্রমব্যাপ্তির ঝলক সাম্প্রতিক কালে দেখেছি মিশর-সহ আরব দুনিয়ার নানা দেশে, ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত যে নতুন গোত্রের জন-আন্দোলন শাসক ও শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের শাহবাগেও দেখেছি জেদে, প্রতিবাদে অকুতোভয় হাজার হাজার তরুণতরুণীর মুখ। এমনই তরুণ মুখের প্লাবন কি দিল্লির রাজপথে ‘দামিনী’র জন্য দেখিনি— যাদের জলকামানে, কাঁদানে গ্যাসে, শাসকের টিটকিরিতে (প্রতিবাদী মেয়েদের ‘ডেন্টেড অ্যান্ড পেন্টেড’ আখ্যা স্মর্তব্য) থামানো যায়নি। আজ থেকে দু’তিন দশক আগে, পিছনে শক্তিশালী সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা না থাকলে প্রান্তিক কোনও ঘটনায় এমন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়া সামাজিক প্রতিবাদ বা আন্দোলনের কথা ভাবাও যেত না। ভাবা যেত না বলেই তখন মরিচঝাঁপি বা বিজন সেতুর ভয়াবহ ঘটনার পরেও শাসকের বিচলিত মনে হয়নি। বা, বানতলার পরে সদম্ভে বলতে পেরেছিলেন, ‘এ রকম তো কতই হয়...!’ (আজ যদি এমন ঘটনা ঘটে, তবে টিভির পরদায় বা ফেসবুকের অ্যাকাউন্টে তার ভয়াবহ দৃশ্যময়তার পুনঃপুনঃ ব্যবহারের সম্ভাবনা ও তার ফলাফলের কথাটা ভেবে দেখবেন!) নাগরিক সমাজ এবং ‘সামাজিক’ ও বড় মিডিয়ার যুগ্ম-প্রভাব যে কতটা ব্যাপক হতে পারে, তা তো সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময়েই দেখেছি। কয়েক বছরের ব্যবধানে তার ব্যাপ্তি এত বেশি যে, এখনকার ঘটনা আগেকার ঘটনাগুলির এক-দশমাংশ হলেও তার প্রভাব কয়েকশো গুণ হবে। কেননা, যোগাযোগের প্রযুক্তি এখন তথ্য-বিনিময়ের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরকে প্রায় এক পঙ্ক্তিতে বসিয়েছে। ফলে, নিছক দলীয় সংগঠন দিয়ে তা পুরোপুরি ‘ম্যানেজ’ করাও যাবে না। শাসককে আজ অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। ভবিষ্যতের শাসকদের আরও আরও বেশি।
কিন্তু কথা হল, জনপরিসরের এই বিপুল ব্যাপ্তি ও শক্তির যুগেও কেন বাংলার নাগরিক সমাজ তার নিজের শক্তিকে, আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যকে চিনবে না? দলীয়তার কুৎসিত বিভাজনে কেন সে নিজেকে জড়াবে? মেষশাবকদের ভিড়ে মিশে থাকা সিংহশিশুটির আজ বোধহয় একখানা আয়নার বড় প্রয়োজন!

শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.