পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি পর্বে বিরোধী দলগুলি বার বারই সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলছে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে। যদিও তা মানতে নারাজ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবারও মিনাখাঁর সভায় মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, “তৃণমূল সন্ত্রাস করছে বলে নাটক করছে সিপিএম।”
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের মন্তব্য, “মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে হিংসাকে সঙ্গী করে ফ্যাসিস্ট-সুলভ কর্মকাণ্ড চলছে!” তথ্য দিয়ে রবীনবাবু এ দিন দাবি করেন, চলতি বছরেই এ পর্যন্ত ১৫ জন বাম কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছেন। তার মধ্যে নির্বাচনী পর্বে গত ২১ জুন পর্যন্ত ৮ জন। রবীনবাবুর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরে কোনও সংঘাত বা খুন হয়নি বলছেন! অথচ শুধু বামপন্থী নয়, বিজেপি প্রার্থী পর্যন্ত খুন হয়েছেন। আসলে মিথ্যা বলতে উনি অভ্যস্ত!” পুরুলিয়ায় বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর দাবি, দু’বছরে ১০২ জন বাম কর্মী খুন হয়েছেন। শনিবারও রেজিনগরে দু’জনকে খুন করা হয়েছে। এ দিনই বর্ধমানে গিয়ে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কর্মীদের প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “কী করে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব? আমাদের কর্মীরা জানতে চাইছেন, কত দিন এই আক্রমণ চলবে? কী করে এ সব বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি।”
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তাঁর দাবিতেই অনঢ়। মিনাখাঁয় তিনি আরও বলেন, “অনেকে বলছে, আমরা নাকি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেক জায়গায় জিতে গিয়েছি। সিপিএম কি ভুলে গিয়েছে চমকাইতলা, শাসন, রাজারহাট, হাড়োয়া, মিনাখাঁ মতো জায়গায় তো ওরা ভোট করতেই দিত না। রাজ্যে এখন আইনশৃঙ্খলা সব থেকে ভাল। যদি সত্যিই তৃণমূল সন্ত্রাস করত, তা হলে গত পঁয়তিরিশ বছরে সিপিএমের অত্যাচারের কথা মনে করে ওদের পিঠের একটি হাড়ও আস্ত থাকত না।” মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সুর টেনেই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় ক্যানিংয়ে এক সভায় বলেন, “পঞ্চায়েত ভোটে মনোনয়ন জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে রাজ্যে কোনও সন্ত্রাস হয়নি।”
শাসক দল এই দাবি করলেও পঞ্চায়েত ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই গণ্ডগোলের ঘটনা বাড়ছে জেলায় জেলায়। রবিবার বারাসত-২ ব্লকের ফলতি বেলিয়াঘাটা পঞ্চায়েতের উত্তর ফলতি গ্রামে মিছিল বের করে সিপিএম। অভিযোগ, তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা মিছিল লক্ষ্য করে বোমা-গুলি ছোড়ে। কুদ্দুস সাহাজির নামে এক জনের পায়ে গুলি লাগে। বোমার স্প্লিন্টারে জখম হন আরও এক জন। পরে বারাসত-বসিরহাট শাখার ফলতি-বেলিয়াঘাটা স্টেশনে অবরোধ করে সিপিএম। র্যাফ মোতায়েন করা হয়েছে। অন্য একটি ঘটনায়, ওই ব্লকেরই গোলাবাড়ি পঞ্চায়েতের তেঘরিয়া গ্রামে বেশ কিছু সিপিএম সমর্থকদের দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। কর্মী-সমর্থকদের মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দু’জন জখম হন।
বিকেলে দত্তপুকুরে গৌতম দেবের সভা ছিল। সভায় আসার পথে সিপিএম সমর্থকদের পথ আটকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। তিন জন জখম বলে সিপিএমের দাবি। প্রতিবাদে মিনিট পঁয়তাল্লিশের জন্য যশোহর রোড অবরোধ করা হয়। সব ক’টি ক্ষেত্রেই হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল।
অন্য দিকে, পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন ১ ব্লকের চক ইসমাইলপুরের তৃণমূল নেতা নবকুমার মহাপাত্রের উপরে হামলার ঘটনায় অভিযোগ সিপিএমের বিরুদ্ধে। পাল্টা হামলায় নিমপুরের ১২ জন সিপিএম কর্মী-সমর্থকের বাড়িতে ভাঙচুর চলে। আহত হন পাঁচ মহিলা, এক দশম শ্রেণির ছাত্র-সহ ১২ জন। গোলমাল চলছে ঘাটালেও। অভিযোগ, প্রচারে বের হলেই শাসকদলের বাইক বাহিনী হুমকি দিচ্ছে। না মানলে চলছে বাড়ি ভাঙচুর, মারধর।
পশ্চিম মেদিনীপুরেরই বেলিয়াবেড়ায় এ দিন এক তৃণমূল কর্মীর দেহ উদ্ধার হয় ডোবা থেকে। মিলন মাইতি (৩৬) নামে ওই যুবক শনিবার সন্ধে থেকে নিখোঁজ ছিলেন। অভিযোগ, সিপিএমই চক্রান্ত করে তৃণমূলের কুজড়া বুথ কমিটির সদস্যকে মিলনকে খুন করেছে। এই ঘটনার জেরে এ দিন লাগোয়া পদিমা গ্রামে এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতেও ভাঙচুর হয়।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে রাজি না-হওয়ায় ফরওয়ার্ড ব্লকের এক প্রার্থীর স্বামীকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শুক্রবার রাতে কোচবিহারের সিতাইয়ের আদাবাড়িঘাট এলাকার ঘটনা। তৃণমূলের দাবি, অভিযোগ ভিত্তিহীন। মিথ্যা মামলা সাজাতে ওই ব্যাক্তি আত্মগোপন করে রয়েছেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের নলমুড়ি এলাকাতেও গোলমাল বাধে দু’পক্ষের। তৃণমূলের দাবি, সুরজ মোল্লা নামে এক সিপিএম সমর্থক পতাকা ছিঁড়ে দিয়েছে। সিপিএমের পাল্টা অভিযোগ, দলীয় বৈঠক চলাকালীন তৃণমূল সমর্থকেরা চড়াও হয়ে মারধরের চেষ্টা করে।
সব মিলিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের আগে হিংসার ঘটনা অব্যাহত। যেমন অব্যাহত রাজনৈতিক চাপানউতোর। |