অনুজ-ডালিমরা নেই, তৃণমূলের দৌলতে মাঠে সিপিএম
কটা নয়, দু’টো নয়, তিন-তিনটে কাস্তে-হাতুড়ি-তারা পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে সদ্য আঁকা হয়েছে শৌখিন, সাদা রঙের দোতলা বাড়ির দেওয়ালে। ভুল হল। দেওয়ালটা যে কাঠামোর, সেটা কখনও বাড়ি ছিল। এখন বাসযোগ্য নয়। ছাদই হাওয়া।
২০০৯-এর জুনে ধরমপুর গ্রামে মাওবাদীদের নেতৃত্বে জনতা সেই সময়ে লালগড়ে সিপিএমের দাপুটে নেতা অনুজ পাণ্ডের ওই অট্টালিকা ভেঙেচুরে ফোঁপরা করে দিয়েছিল। ধ্বংসলীলা যখন চলছিল, তখন বাড়িটার সামনে কাঁধে একে-৪৭ ঝুলিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন মাওবাদী নেতা বিকাশ। ধরমপুরে সিপিএমের পার্টি অফিসেও আগুন লাগানো হয়। তার আগেই এলাকা ছেড়ে পালান দলের বিনপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডে, তাঁর তুতো-ভাই তথা ধরমপুরে পার্টির লোকাল কমিটির সম্পাদক ডালিম পাণ্ডে-সহ নেতা-কর্মীরা। ধরমপুরের রাজনৈতিক ময়দানে অনুজ ছিলেন সিপিএমের কোচ। আর ডালিম অবশ্যই ক্যাপ্টেন। ২০১০-এর সেপ্টেম্বরে ফের এলাকায় ঢোকেন অনুজ-ডালিম। কিন্তু চার মাসের মাথায় নেতাই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হওয়ার পর ফের এলাকা ছাড়েন। এখনও ফেরার পাণ্ডে ভাইয়েরা।
কিন্তু অনুজ পাণ্ডের বাড়ির দেওয়ালে জ্বলজ্বলে অস্তিত্ব তাঁর পার্টির। এবং গোটা ধরমপুরেও। অনুজ-ডালিম অনুপস্থিত, কিন্তু সিপিএম গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০টার মধ্যে ১০টা আসনেই, পঞ্চায়েত সমিতির দু’টোর মধ্যে দু’টোয়, আর এই জায়গায় জেলা পরিষদের একটি মাত্র আসনেও প্রার্থী দিচ্ছে অবলীলায়। গোটা ধরমপুর জুড়ে তাদের প্রচারও চলছে পুরোদমে।

ধরমপুরে অনুজ পান্ডের বাড়িতে
দেওয়াল লিখন। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
লালগড় থেকে আট কিলোমিটার দূরের এই ধরমপুর সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে মোট আটটা আসনের সবগুলোয় জিতেছিল তারা। এমনকী, ২০১১-য় পরিবর্তনের ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়েও ঝাড়গ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই গ্রাম পঞ্চায়েতে সিপিএম ৪২০ ভোটের মতো ‘লিড’ পেয়েছিল। অথচ, লালগড় আন্দোলনের সময়ে এই ধরমপুর এলাকাতেই সিপিএমের ২০ জন কর্মী খুন হয়েছেন। সেই ২০০৯ থেকে এখনও নিখোঁজ ১২ জন দলীয় কর্মী। সব মিলিয়ে অনুজ পাণ্ডের বাড়ির মতো তাঁর পার্টিরও এখানে অস্বস্তিতে থাকার কথা। অথচ সিপিএমের শরীরী ভাষা দেখলে বোঝার উপায় নেই, এলাকার তাবড় নেতারা ছাড়াই তাদের লড়তে হচ্ছে।
এবং তৃণমূলের সন্ত্রাস নিয়ে কোনও কাঁদুনিও এখানে গাইছে না সিপিএম। ধরমপুরে পার্টির হয়ে নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্বে থাকা সুনীল মাহাতো বলেন, “তৃণমূল হুমকি দিয়েছিল আমাদের প্রার্থীদের। কেউ পাত্তা দেয়নি। ওরা আমাদের প্রার্থীদের বলেছে, ভোটের পরে দেখে নেবে। আমরা বলেছি, ‘তোরা কত কী দেখবি, জানা আছে’।”
অনুজ পাণ্ডের বাড়িতে হামলা ও পার্টি অফিসে আগুন লাগানোর ঘটনাতে ইঙ্গিত ছিল, মাওবাদী-মদত থাকলেও সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ সেই সময়ে স্থানীয় সিপিএম নেতাদের উপরে হাড়ে-হাড়ে চটে ছিলেন। উপরন্তু অনুজ-ডালিমও এলাকাছাড়া। তার পরেও সিপিএম গ্রাম পঞ্চায়েতের সব আসনে প্রার্থী দিতে পারল কী ভাবে?
ধরমপুর থেকে সিপিএমের এ বারের জেলা পরিষদ প্রার্থী, হদদি গ্রামের বাসিন্দা বছর পঁচিশের যুবক ভূপেন মাহাতোর দাবি, “মাওবাদীদের সঙ্গে থেকে চার বছর আগে যারা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তারাই এখন ধরমপুরের তৃণমূলের নেতা। যে দিলীপ মাহাতোর বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ, তোলাবাজি এবং দেশদ্রোহের অসংখ্য মামলা ঝুলছে, সেই দিলীপ মাহাতো তৃণমূলের ধরমপুরের অঞ্চল সভাপতি। ওঁর সঙ্গেই আছে সন্তোষ মাহাতো, লসো হেমব্রম, সুন্দর মান্ডি, রাজু আদক, জয়দেব বেরা, হুন সাঁতরার মতো বিতর্কিত লোক জন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বহু মামলা। অথচ, সবাই এই এলাকায় এখন তৃণমূলের মুখ। এতে বিরাট সুবিধা হয়েছে। মানুষকে বোঝাতে হয়নি, এরা কারা।”
তৃণমূলের এই এলাকার শীর্ষ নেতা দিলীপ মাহাতোর বাড়ি ভুলাগাড়া গ্রামে, অথচ তিনি এখন পাকাপাকি ভাবে থাকেন লালগড়ে। দিলীপের বক্তব্য, “ভুলাগাড়ায় আমার ঘরবাড়ি তো সিপিএমের হার্মাদরা ভেঙে দিয়েছে।” কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে তো মাওবাদীদের সঙ্গে থেকে সন্ত্রাস করার বহু অভিযোগ রয়েছে। “আমি মাওবাদীদের সাহায্যে এই এলাকায় জনসাধারণের কমিটি তৈরি করেছিলাম। সে কথা অস্বীকার করব কেন? কিন্তু মাওবাদীরা না থাকলে কি অনুজ পাণ্ডে, ডালিম পাণ্ডেদের এলাকা থেকে হটানো যেত?” মাওবাদী-ঘনিষ্ঠেরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় সিপিএমের কি সুবিধা হয়ে গেল না? সরাসরি জবাব না দিয়ে দিলীপবাবুর দাবি, “এলাকায় সব পঞ্চায়েত আসনে আমরা জিতব।”
তবে শুধু তৃণমূলে কারা আছেন দেখিয়ে নয়, সিপিএম অন্য কৌশলও নিয়েছে ধরমপুরে। গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০টা আসনের প্রার্থীদের মধ্যে পার্টি সদস্য মাত্র তিন জন। বাকি সবাই ভূপেন মাহাতোর মতো একেবারে নতুন মুখ। ডালিমের অনুপস্থিতিতে লোকাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা বিনয় পাণ্ডে, গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান পূর্ণ মাহাতোর মতো পুরনো মুখদের ভোট-প্রচারে যথাসম্ভব কম ব্যবহার করা হচ্ছে। মাওবাদীদের হাতেই নিহতদের পরিবারের তিন জন সদস্যকে চামটারা উত্তর, মধ্যমকুমারী এবং শালবনি আসনে প্রার্থী করেছে সিপিএম। তা ছাড়া, দলে যাঁদের বিরুদ্ধে দাদাগিরি, জুলুমের অভিযোগ ছিল, তাঁরা দীর্ঘদিন এলাকায় নেই বলে এলাকাবাসীর স্মৃতিতেও আবছা হয়ে যাবেন, এমনটাও মনে করছেন সিপিএমের স্থানীয় নেতাদের একাংশ।
তাতে কাজ হচ্ছে কি?
ধরমপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা বলেছেন, “সিপিএম আমাদের এখানকার এতদিনের পার্টি। তৃণমূলকে তো হালে দেখতে পাচ্ছি। নেতারা নেই বটে, কিন্তু সিপিএম পার্টিটা তো আর উঠে যায়নি।”
কোচ-ক্যাপ্টেন নেই। তবু ধরমপুরে মাঠ জুড়ে খেলছে ‘টিম সিপিএম’।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.