নিহতের সংখ্যা অনায়াসে হাজার ছাড়াইতে পারে। হিমাচলপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে যাহা ঘটিল, তাহা নিঃসন্দেহে এক বৃহৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু ইহা কি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক? না কি, যাহা ঘটিয়াছে, তাহা মানুষের কর্মকাণ্ডের পরিণাম, ঘটিবার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল? ইহা কি আসলে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’? বছরের পর বছর হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে এমন অনেক কিছু ঘটানো হইয়াছে, যাহা প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যের অনুকূল নয়। এই পার্বত্যভূমি গভীর, গহন, চিরহরিৎ, সরলবর্গীয় বৃক্ষ-আচ্ছাদনে আবৃত ছিল। বৃক্ষের শিকড় পাহাড়ের পাথরকে আঁকড়াইয়া থাকিত। কাঠব্যবসার দাপটে সেই অরণ্য বহুলাংশে নিশ্চিহ্ন। তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে অগণিত পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করিতে অগণিত হোটেল-মোটেলের নির্মাণ। উপরন্তু খরস্রোতা পাহাড়ি নদীগুলির জলধারা রুদ্ধ করিয়া বহু ছোট-বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ চলিয়াছে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের অনেকের মতে, এই সব মিলাইয়া এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বহু বার সরকারকে সতর্ক করিয়াছেন। ‘চিপ্কো’-র মতো সামাজিক আন্দোলন বহু বার এই শঙ্কার প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাহিয়াছে। কিন্তু কি সমাজ, কি সরকার, কোনও পক্ষই আশু লাভকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়া অনাগত ভবিষ্যতের অশনিসংকেত উপলব্ধি করিতে চাহে নাই। তাহার পরিণামই কি সকলের চোখের সামনে?
এ দেশে দুর্গতদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাইতে বরাবরই বিলম্ব হয়, প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ত্রাণ আসে এবং তাহাও ঠিকমত বিলিবণ্টন হয় না। এই বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও তাহার ব্যত্যয় ঘটে নাই, যদিও পরিত্রাতা ও উদ্ধারকারীর ভূমিকায় সেনাবাহিনী ও ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশের ভূমিকা সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসা কুড়াইয়াছে। আপাতত প্রথম কাজ ত্রাণ ও পুনর্বাসনের যথাযোগ্য বন্দোবস্ত। কিন্তু তাহার পরে রহিয়াছে দীর্ঘমেয়াদি আয়োজনের দায়িত্ব। হিমাচলপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যের সরকারকে অতঃপর কতকগুলি বিষয়ে বাড়তি নজর দিতেই হইবে। পর্যটক ও পুণ্যার্থীদের চাপ সহনীয় ও সুস্থায়ী মাত্রায় নামাইয়া আনিতে হইবে। এই চাপই কিন্তু বেআইনি নির্মাণ, নদীর বুকের উপরেও হোটেল-ধর্মশালা-রেস্তোরাঁ গড়ার প্রবণতার জন্ম দেয়। চিন যে ভাবে কৈলাস-মানস সরোবরের পর্যটন ও তীর্থযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। অমরনাথ ও বৈষ্ণোদেবী যাত্রার মতো অন্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ জরুরি। উত্তরাখণ্ড ব্যাপী নদীর উপর নির্মিত ও নির্মীয়মাণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির পর্যালোচনাও জরুরি। উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। কিন্তু যে-উন্নয়ন পরিবেশবান্ধব নয়, বরং বিপর্যয় ঘনাইয়া তোলে, তাহা শেষ বিচারে আত্মঘাতী। বলা হয়, অতীত ভুল হইতে যাহারা প্রয়োজনীয় শিক্ষাগ্রহণ করে না, তাহারা ভবিষ্যতেও সেই ভুলগুলিরই পুনরাবৃত্তি করিতে নিয়তিনির্দিষ্ট। উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় সেই অর্থে একটি সুযোগও বটে আত্মসংশোধনের সুযোগ। |