শুক্রবার কলিকাতার রাজপথে যে মিছিল দেখা গেল, ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ‘নন্দীগ্রাম’ মিছিলের সহিত তাহার তুলনা অনিবার্য এবং স্বাভাবিক। তুলনীয় মানেই অভিন্ন নয়। দুই মিছিলের এবং তাহার প্রেক্ষাপটের পার্থক্য আছে, নানা ধরনের পার্থক্য। দুই উদ্যোগে ও তাহার রূপায়ণে দলীয় রাজনীতির ভূমিকাও হয়তো এক ছিল না। কিন্তু এই দিন যে নাগরিক জাগরণ দেখা গেল, তাহা একটি মৌলিক অর্থে সাড়ে পাঁচ বছর আগের সেই অভিযানের ধারাবাহিকতা বহন করিয়াছে। সে দিনের মতো এই দিনও পশ্চিমবঙ্গের, মুখ্যত কলিকাতার নাগরিক সমাজের একটি অংশ স্পষ্ট ভাষায় এবং ভঙ্গিতে জানাইয়া দিয়াছে, রাষ্ট্রশক্তির অন্যায় তাহারা মুখ বুজিয়া সহ্য করিবে না। শুক্রবারের মিছিলের কারণগুলির পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তাহার একটি প্রতীকী অর্থ অবিস্মরণীয়। মুখ্যমন্ত্রী তাহার চার দিন আগে কামদুনি সফরে গিয়া যে ‘চুপ’ বলিয়াছিলেন, মহানগরীর মিছিলটি তাহার একটি সমুচিত জবাব হিসাবে তাঁহার সম্মুখে সপাটে আছড়াইয়া পড়িয়াছে। ২০০৭ সালে ঠিক এই ভাবেই তদানীন্তন শাসক দল তথা তাহার মুখ্যমন্ত্রীর স্পর্ধিত আস্ফালনের জবাব দিয়াছিল এই শহর। ক্ষমতার মুখের উপর সত্য বলিবার এই চেতনা গণতন্ত্রের অপরিহার্য রক্ষাকবচ। লক্ষণীয়, গত কয়েক বছরে দুনিয়া জুড়িয়া জনআন্দোলনের বহু নজির দেখা গিয়াছে, এই মুহূর্তেও তুরস্ক এবং ব্রাজিলের মতো দুই গোলার্ধের দুইটি দেশে আন্দোলন চলিতেছে। দুনিয়া জুড়িয়া শাসকরা বুঝিতেছেন, ‘চুপ’ বলিয়া জাগ্রত নাগরিক সমাজকে চুপ করাইয়া রাখা আর চলিবে না। এমনকী মমতা বন্দো্যপাধ্যায়েরও হয়তো সেই বোধ কিছুটা হইতেছে, হয়তো সেই কারণেই তিনি শুক্রবারের মিছিলের পরের দিন সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিদ্বজ্জনদের ‘সাহায্য’ চাহিয়াছেন, তাঁহাদের উদ্দেশে বলিয়াছেন, ‘মানুষের মধ্যে একটু জাগরণ করুন’!
বিদ্বজ্জন তথা নাগরিক সমাজের এই ভূমিকা নিশ্চয়ই জরুরি। কামদুনির দুই তরুণ সাহসিনীর প্রতিক্রিয়াতেও তাহা স্পষ্ট। কিন্তু ইহার ফলে কি প্রশাসন এবং তাহার নিয়ামক রাজনীতিকদের আচরণ কিছুমাত্র বদলাইবে? মুখ্যমন্ত্রী নিজে যে কোনও প্রশ্নের মুখে পড়িলে যে ভাবে সম্পূর্ণ অহেতুক, অশোভন এবং অগণতান্ত্রিক ভঙ্গিতে আক্রমণ করিতেছেন তাহা কি বন্ধ হইবে? গত দুই বছরের অভিজ্ঞতা ভরসা দেয় না, ঠিক যেমন ভরসা দেয় না তাহার পূর্ববর্তী তিন দশকের ইতিহাসও। কিন্তু এই সূত্রেই একটি গভীরতর প্রশ্ন ওঠে। কলিকাতার বুকে নাগরিক সমাজের যে প্রতিবাদ, বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজে তাহার প্রভাব বা প্রতিফলন কতটুকু? বিপরীত দিক হইতে দেখিলে, প্রশাসন তথা তাহার সর্বময়ী কর্ত্রীর যে সমস্ত আচরণ লইয়া নাগরিক সমাজের তীব্র এবং সঙ্গত আপত্তি, বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাহাতে কতটুকু বিচলিত বা ক্ষুব্ধ?
এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত জল্পনাসাপেক্ষ, হয়তো ভবিষ্যৎ নির্বাচনী পরীক্ষাগুলিতে তাহার কিছুটা স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যাইবে। কিন্তু একটি মৌলিক এবং দুর্ভাগ্যজনক সত্য অস্বীকার করিবার উপায় নাই। এই নাগরিক প্রতিবাদ সমাজের যে অংশ হইতে উত্থিত, তাহা কেবল নিতান্ত সংখ্যা-লঘু নয়, অবশিষ্ট সমাজের উপর তাহার মানসিক তথা চেতনাগত প্রভাব সীমিত। বিশেষত, ক্ষমতার রাজনীতি উত্তরোত্তর যে ধারা অনুসরণ করিয়াছে, জনসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন দখল করিতে ও দখলে রাখিতে যে সমস্ত কৌশল কাজে লাগাইয়াছে, সারস্বত সমাজের এই বিবেকী কণ্ঠস্বর তাহার মোকাবিলা করিতে কত দূর সক্ষম হইবে, সে বিষয়ে গভীর সংশয় আছে। মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁহার অনুগামীরা যদি মনে করেন, সমাজের ‘সংস্কৃত’ অংশ কী বলিল না বলিল তাহাতে তাঁহাদের কিছুই যায় আসে না, তাঁহাদের নির্বাচনী পুঁজি ‘প্রাকৃত’ জনসমাজের সমর্থনে দিব্য লালিত হইবে এবং তাঁহাদের গোলায় ক্ষমতার ফসল তুলিয়া চলিবে, সেই ধারণাকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। ইহাতে নাগরিক প্রতিবাদের প্রয়োজন ও গুরুত্ব কমে না, কিন্তু তাহার কার্যকারিতার হিসাবে টান পড়ে। মহানগরীর রাজপথে প্রতিবাদী জনসমাবেশের বিপুলতা দিয়া এই হিসাবের ঘাটতি পূরণ করা যাইবে কি? |