প্রকৃতির রোষেই কি দেবভূমিতে মৃত্যুমিছিল
নারী তথা প্রকৃতির মন বোঝা তা হলে শিবেরও অসাধ্য? যার তাণ্ডবলীলায় পরাভূত স্বয়ং কেদারনাথ! নাকি ঘোর কলিতে পাপের ঘড়া কানায় কানায় পূূর্ণ হলে এ ভাবেই দেবভূমি বদলে যায় বধ্যভূমিতে?
অবশ্য শুধু কেদারনাথ কেন? প্রকৃতির তাণ্ডব থেকে তো বাদ গেল না দক্ষিণ ফ্রান্সে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের অন্যতম পবিত্র তীর্থ ক্ষেত্র লুর্দ-ও। সেই লুর্দ, যেখানে মেষপালিকা হয়ে এক ফরাসি কন্যাকে দেখা দিয়েছিলেন মাতা মেরি। পিরেনিজ পর্বতমালার গলে যাওয়া হিমবাহ এবং ধসে কার্যত রুদ্ধ হয়ে পড়েছে গোটা শহরটি। উপরি হিসেবে আছে তুমুল বৃষ্টি আর প্রবল ঝড়। প্রতি বছর ৬০ লক্ষ তীর্থযাত্রী আসেন এখানে। তাঁদের অনেকেই আটকে পড়েছেন। আপাতত উদ্ধারের কাজ চলছে পুরোদমে।
তা হলে কি পাপের ঘড়া সত্যিই পূর্ণ হয়েছে? হৃষিকেশের ঘাটে পাক খেতে থাকা গঙ্গার ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে গেরুয়া বসন পরা প্রৌঢ় মানুষটিও বিড়বিড় করতে করতে তেমনটাই বলছিলেন। “কলি, ঘোর কলি! কিসিকো নেহি ছোড়েঙ্গে!”
কিন্তু কলি-কে নিয়ে ভাবনার সময় এখন কই? প্রকৃতির রুদ্র রূপের সঙ্গে যুদ্ধে যেখানে দেবাদিদেবকেও হার মানতে হয়েছে, সেখানে প্রকৃতিরই গড়ে দেওয়া মরণফাঁদ থেকে আটকে পড়াদের জীবিত ফিরিয়ে আনার এক অসম্ভব চ্যালেঞ্জকে সফল করতে মরিয়া সামরিক বাহিনী। তা-ও আবার সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে। সেনার ‘অপারেশন সূর্য হোপ’-ই এখন দেবভূমির নানা প্রান্তে আটকে পড়া হাজার হাজার মানুষের কাছে একমাত্র আশার আলো।
উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ে মৃতদের উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য ইলাহাবাদে। রবিবার।
কিন্তু সে আলোও তো দ্রুত কমে আসছে। কারণ? সেই প্রকৃতি। কাল, সোমবার থেকেই তার ফের অশান্ত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিয়েছে দিল্লির মৌসম ভবন। আর তাতেই আতঙ্কে কাঁটা হয়ে রয়েছেন সকলে। এখনও বহু মানুষ আটকে দেবভূমির নানা প্রান্তে। সরকারি হিসেবেই সংখ্যাটা প্রায় বিশ হাজার! তাঁদের উদ্ধারের কী হবে? যত সময় যাচ্ছে, উদ্বেগের পারদটা তত চড়ছে। প্রিয়জনদের ফিরে পাওয়ার আশায় দেরাদুন-হরিদ্বারে ভিড় করে থাকা পরিবারের লোকেদের ধৈর্যের বাঁধও ভাঙছে।
দেরাদুনের অস্থায়ী শিবির থেকে থেকে হৃষিকেশের পরমার্থ আশ্রম হয়ে হরিদ্বারের হর-কি-পৌরি ঘাট সর্বত্রই আটকে পড়া ওই লোকগুলোর জন্য উদ্বেগ আর প্রার্থনা। তার মধ্যেই যে যে রকম ভাবে পারছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেনার মতো অত রসদ বা ক্ষমতা নেই। তবু বসে না থেকে নিজেদের সামর্থটুকু উজার করে ত্রাণে ঝাঁপিয়েছেন হরিদ্বারের সন্ধ্যা আরতির মূল ঘাটের সন্ন্যাসীরা। বসে নেই হৃষিকেশ বা গুপ্তকাশীর সন্ন্যাসীরাও। অসুস্থদের সেবা থেকে অভুক্তদের জন্য খিচুড়ি রান্না, সব কিছুই করছেন হাসিমুখে। আর তার মধ্যেই তারস্বরে গাল পাড়ছেন মানুষের লোভকে।
গোটা দেশের পরিবেশবিদেরা যা বলছেন, এঁরা তার থেকে কিছু অন্য কথা বলছেন না। সেই সঙ্গে বলছেন অনাচারের কথাও! যার জন্যই নাকি দেবতা এতটা রুষ্ট হয়েছেন। না হলে হয়তো কম শাস্তিই দিতেন তিনি। হর-কি-পৌরির এক সন্ন্যাসীর বক্তব্য, উত্তরাখণ্ডে মেঘ ভেঙে বৃষ্টি আছড়ে পড়ার ঠিক আগের দিনই কেদারনাথে ধারি দেবীর (কালী) মন্দির থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল প্রতিমা। একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার জন্যই নাকি ধারি দেবীর এই স্থানান্তর। সেই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাঠামো এখন মন্দাকিনীর জলে!
শুধু কি সন্ন্যাসী? গত প্রায় কুড়ি বছর ধরে কেদারনাথে মহাদেবকে দর্শন করতে যান গুজরাতের বস্ত্রব্যবসায়ী সঞ্জীব ত্রিবেদী। এ বারেও গিয়েছিলেন এবং অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন। বললেন, “১৯৮২ সালেও এই রকমের একটা কাজ করা হয়েছিল। সে বারেও মা কালীর মূর্তি সরানোর পরে ধস নেমেছিল কেদারের পাহাড়ে। কালী মা অনাচার সহ্য করেন না।” বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের এই আলো-আঁধারির বাইরে এসে দাঁড়িয়েও একটি তথ্যকে কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সেটি হল গত এক বছরে কেদার এবং বদ্রীতে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে চার গুণ! আর এই দৈব-পর্যটনে ফুলে-ফেঁপে ওঠার মধ্যে মুনাফার গন্ধ জড়িয়ে থাকায় ছত্রাকের মতো বেড়েছে পার্কিং লট, হোটেল, রেস্তেরাঁ, শপিং মল। তার জন্য যথেচ্ছ কাটা পড়েছে বড় বড় গাছ। নদীর খাত দখল করে মনোরম রিসর্ট। আর তার ফল? পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৫ থেকে এই ক’বছরে তিন-তিনটি বড় বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে উত্তরাখণ্ড। আগে শেষ বড় বন্যা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে।
আসলে দু’হাজার সালে উত্তরাখণ্ড গঠনের পর থেকে উন্নয়নের নামে ধারাবাহিক ভাবে ডিনামাইট ফেটেছে পাহাড়ে। ফলে ভেঙে পড়েছে এখানকার গোটা পরিবেশ ব্যবস্থাই। টানেল, রাস্তা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সংখ্যা যত বেড়েছে, ভিতর থেকে ততটাই আলগা হয়ে গিয়েছে পাথরের বুনোট! অলকানন্দা, মন্দাকিনী এবং ভাগীরথী নদীর উপর গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৭০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ফলে নদীর স্বাভাবিক স্রোত প্রবল ভাবে ব্যাহত হয়ে জন্ম দিয়েছে বিপদের।
এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে এক দল সাধুর কথা না-লিখলেই নয়। দেবভূমিতে গত এক শতকের সব চেয়ে বড় তাণ্ডব দেখার পরেও শিব এবং শক্তির অটুট মেলবন্ধনের উপর আস্থা রেখে প্রলয়ের ‘শেষ দেখে নিতে’ চাইছেন শ’দুয়েক সাধু!
এবং সেটা কেদারের মৃত্যুপুরীতে থেকেই! হরিদ্বারের স্টেট এমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের এক কর্তা আক্ষেপ করেন, “অনেক সাধ্য সাধনা করেছি। কিন্তু ওঁদের কেদার থেকে নড়ানো যায়নি!”

ধ্বংসস্তূপে প্রাণ
ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই পৃথিবীর আলো দেখল ওরা। ১৫ কিলোমিটার ট্রেক করে বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ডের তিজন গ্রামে গিয়ে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল দেখেন দুই অন্তঃসত্ত্বা মহিলা রয়েছেন। প্রসবের জন্য একটি অস্থায়ী শিবির তৈরি করা হয়। হেলিকপ্টারে নিয়ে আসা হয় মহিলা চিকিৎসককে। দুই মহিলা একটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম দেন। সদ্যোজাত আর তাদের মায়েরা সুস্থ আছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.