বেতন নিয়ে আশাভঙ্গ আর গবেষণা পরিকাঠামোর অভাব। একের পর এক শিক্ষকের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার পিছনে এই দু’টি কারণের কথাই শোনা যাচ্ছে বেশি।
এর মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর গ্রুপের চেয়ারম্যান সুগত বসু। প্রেসিডেন্সিতে গবেষণার যথাযথ পরিকাঠামো না-থাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষকদের অনেকেই ইস্তফা দিয়েছেন বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, এই সমস্যার সমাধানের জন্য শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর থেকেও গবেষণার পরিকাঠামো তৈরি করাটাই এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মেন্টর গ্রুপের চেয়ারম্যান রবিবার প্রেসিডেন্সির একটি অনুষ্ঠানে বলেন, “শিক্ষকদের বেতন না-বাড়ালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর দ্রুত উন্নয়ন দরকার। নইলে ভবিষ্যতে শিক্ষকদের প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যাওয়া আটকানো যাবে না।” বিষয়টি নিয়ে ১৫-১৬ জুলাই মেন্টর গ্রুপের সব সদস্যকে নিয়ে বৈঠক করবেন সুগতবাবু। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী ও মেন্টর গ্রুপের মুখ্য উপদেষ্টা অমর্ত্য সেনও ওই সময় কলকাতায় থাকবেন। মেন্টর গ্রুপ এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গেও কথা বলবে।
প্রেসিডেন্সিতে গবেষণার পরিকাঠামো কতটা খারাপ, তা ধরা পড়েছে সুগতবাবুর বক্তব্যেই। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্সিতে দেড়শোর বেশি শিক্ষক আছেন। তাঁদের অনেকে গবেষণা করতে চাইলেও করতে পারছেন না। পরিকাঠামোর অভাবই তার কারণ। অনেকে নিজস্ব পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে গবেষণার জন্য যন্ত্রপাতি কেনার অনুদান আনতে চাইলেও সেই যন্ত্র রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। ফলে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।” অর্থাৎ গবেষণার আদর্শ পরিকাঠামো আর বাতাবরণের অভাবটাই কাঁটা। সেটা তুলতে না-পারলে ভাল শিক্ষকদের ধরে রাখা সম্ভব নয় বলে মনে করেন সুগতবাবু।
মেন্টর গ্রুপের চেয়ারম্যানের বক্তব্য, যাঁরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল গবেষণার পরে শিক্ষকতার জন্য এখানে আসছেন, তাঁরা পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন। কিন্তু বর্তমানে প্রেসিডেন্সির গবেষণাগারগুলির হাল এতই খারাপ যে, সেখানে ভাল কাজ করা সম্ভব নয়। তাঁর আশঙ্কা, পরবর্তী কালেও এই নিয়ে সমস্যা হতে পারে। ভাল শিক্ষকেরা প্রেসিডেন্সিতে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত এই কারণে আর না-ও যোগ দিতে পারেন।
প্রেসিডেন্সিতে গবেষণা সংক্রান্ত পরিকাঠামোর হাল কেমন?
ওই বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, অবিলম্বে বেকার ভবনের পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যার গবেষণাগার দু’টির সামগ্রিক উন্নয়ন দরকার। ছাত্র-শিক্ষক আলোচনার জন্য দরকার শিক্ষকদের বসার আলাদা ঘর। বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা থাকলেও সেই পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে মেন্টর গ্রুপ, সকলেই এই বিষয়ে চিন্তিত। শিক্ষকদের প্রেসিডেন্সি-বিরাগ ইদানীং প্রকট হয়ে ওঠায় সেই চিন্তা বেড়েছে।
গত কয়েক মাসে সাত জন শিক্ষক প্রেসিডেন্সি ছেড়ে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক জনকে অবশ্য ইস্তফা দিতে বাধ্য করানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মালবিকা সরকার বলেন, “যাঁরা চলে গিয়েছেন, তাঁদের তিন
জন কম বেতনের জন্য প্রেসিডেন্সি ছেড়েছেন। অন্যেরা ছেড়েছেন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে।” যদিও ঘনিষ্ঠ মহলে ওই শিক্ষকেরা জানান, গবেষণার পরিকাঠামো নেই বলেই তাঁরা ইস্তফা দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্সি থেকে একের পর এক শিক্ষক ছেড়ে চলে যাওয়ায় আচার্য তথা রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সকলেই উদ্বিগ্ন। বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহেই উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলেন আচার্য। উপাচার্যের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে শিক্ষামন্ত্রীরও। গবেষণা-সহ প্রেসিডেন্সির নানা পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য উপাচার্য নভেম্বরেই ৫০ কোটি টাকা চেয়ে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়েছিলেন। সাত মাসেও শিক্ষা দফতর থেকে সেই চিঠির জবাব আসেনি। আজ, সোমবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে উপাচার্যের বৈঠক হওয়ার কথা। সেখানে এই প্রসঙ্গ উঠতে পারে।
পরিকাঠামোর উপরে বেশি জোর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুগতবাবু মনে করেন, প্রেসিডেন্সিকে ‘সেন্টার অফ এক্সেলেন্স’ বা উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষকদের বেতনও বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতনক্রম অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের রাজ্যের আর্থিক অবস্থা খারাপ। তাই বেতন বাড়াতে না-পারলেও ভাল গবেষণা ও উন্নত মানের গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য শিক্ষকদের উৎসাহ ভাতা দেওয়া দরকার। এটা করলে মোট বেতন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকটাই কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।”
রাজ্যের শিক্ষা দফতর অবশ্য এ ব্যাপারে তাদের মত পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, যাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-পদে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা তো বেতনের বিষয়টি জেনেই এসেছেন। দেশের অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানকার শিক্ষকেরাও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর নির্ধারিত বেতনক্রম অনুযায়ী বেতন পান। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তার থেকে আলাদা কিছু করা সম্ভব নয়।
একই বক্তব্য শিক্ষামন্ত্রীর। |