বিষণ্ণ বৃহস্পতিবার। ভারতীয় অর্থনীতি তথা লগ্নির জগতে এমন খারাপ দিন খুব বেশি আসেনি। ভারতীয় টাকার তুলনায় ডলার যে-দিন উঠেছে সর্বোচ্চ উচ্চতায়, সেই দিন সেনসেক্স পড়েছে ৫৩৮ পয়েন্ট বা ২.৮%। ওই দিন নিফটির পতন পৌঁছে গিয়েছে ৩%-এর কাছাকাছি। কম-বেশি পতন হয়েছে বিশ্ব জুড়ে সব শেয়ার বাজারেই। এক দিনে এতটা পতনে ভারতীয় লগ্নিকারীদের খাতায় লোকসানের পরিমাণ পৌঁছেছে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। একই দিনে আন্তর্জাতিক বাজারে পড়েছে সোনার দামও। ভারতে প্রতি ১০ গ্রাম এই হলুদ ধাতুর দাম কমে প্রায় ৮০০ টাকা। অর্থাৎ দিনটি একই রকম খারাপ ছিল সোনায় লগ্নিকারী এবং সোনা ব্যবসায় নিযুক্ত অসংখ্য মানুষের কাছে।
প্রশ্ন উঠেছে, কেন এমন হল? যে কারণে এই পতন, তার ইঙ্গিত কিন্তু আগে থেকেই ছিল। মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ-এর কর্ণধার বার্নানকে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, মার্কিন অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরতে শুরু করায় শীর্ষ ব্যাঙ্ক বাজার থেকে বন্ড কেনা কমিয়ে আনতে পারে। একই কথা এ বার স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নানকে। অর্থাৎ আর সন্দেহ নেই যে, সরকার বন্ড কেনা কমালে বাজারে ডলারের জোগান কমে আসবে। ফলে ভারতের মতো দেশে ডলার প্রবাহ কমে আসবে। অন্য দিকে মার্কিন অর্থনীতির উন্নতি এবং ভারতীয় অর্থনীতির অবনতি হওয়ায় ভারত থেকে আরও লগ্নি বেরিয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কা দ্রুত গ্রাস করছে বাজারকে। বেশ কয়েক দিন থেকেই ভারতীয় বাজারে শেয়ার এবং বন্ড বিক্রি করে টাকা সরিয়ে নিচ্ছিল বিদেশিরা। বৃহস্পতিবার তারা প্রায় ২১০০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে ভারতীয় বাজারে। ফলে অবাধ পতন হয় সূচকের। গত ২১ মাসে এক দিনে এটিই সর্বোচ্চ পতন।
ডলারের উত্থান অর্থাৎ টাকার মূল্য পতনে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন অনেকেই। তেল, সার-সহ বহু পণ্য আমদানির জন্য সরকারকে গুনতে হবে অনেক বেশি টাকা। আমদানির খরচ বেড়ে ওঠায় বাড়বে চলতি খাতে লেনদেনে ঘাটতি। ভারতে এখন যা ডলার মজুত আছে, তাতে বড়জোর ৭ মাসের ঘাটতি মেটানো যেতে পারে। সরকারের কাছে এটি বড় চিন্তার কারণ। এই ঘাটতি বেড়ে ওঠায় শঙ্কিত বিদেশি লগ্নি -কারীরাও। ডলারের দাম বাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমদানি-নির্ভর বহু শিল্প। দাম বেড়ে উঠতে পারে অনেক পণ্যের। ফলে ঝিমিয়ে পড়া বাজারে চাহিদা আরও কমতে পারে সেই সব শিল্পপণ্যের। অন্য দিকে লাভবান হবে তথ্যপ্রযুক্তির মতো রফতানি-প্রধান শিল্প।
যে-সব কোম্পানি বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে, তাদের সুদ বাবদ এবং ঋণ পরিশোধে গুনতে হবে অনেকটাই বেশি টাকা। ভারতীয় ছাত্রদের বিদেশে পড়ার খরচ বাড়বে। বাড়বে বিদেশ ভ্রমণের খরচও। আমদানি করা ওষুধের জন্য গুনতে হবে বেশি টাকা। সরকারি পদক্ষেপে অবশ্য শুক্রবার সামান্য হলেও টাকার দাম বেড়েছে। দামে ঊর্ধ্বগতি আনতে হলে অবশ্যই বাড়াতে হবে রফতানি। কমাতে হবে অনাবশ্যক পণ্যের আমদানি। ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে বিদেশিরা লগ্নি ফিরিয়ে নেওয়া থেকে বিরত হয়। আকর্ষণীয় বিনিয়োগ প্রকল্প আনতে হবে অনাবাসী ভারতীয়দের জন্য, যাতে তাঁরা ভারতে ডলার পাঠাতে উৎসাহিত হন। অর্থাৎ শুধু পরিস্থিতির উপর লক্ষ রাখলেই চলবে না, সরকারকে সক্রিয় পদক্ষেপ করতে হবে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
সুব্বারাও সুদ কমাননি, তা বাজার মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সামলাতে পারেনি বার্নানকে-র ধাক্কা! ‘বার্নানকে’-বোমা ধস নামিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। এর গভীরতা যেন উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক ধসের সঙ্গে তুলনীয়। এই ক্ষত রাতারাতি সারার নয়। অর্থনীতির অভিমুখ না-ফেরাতে পারলে বাজারকে চাঙ্গা করা শক্ত। বিদেশি লগ্নিকারীরা লগ্নি ফেরত নিতে শুরু করায় ইক্যুইটির বাজার তো বটেই, পতন হয়েছে বন্ডের বাজারেও। ফলে বেশ সঙ্কটে মিউচুয়াল ফান্ড শিল্প। পাশাপাশি, অবস্থা খারাপ গোল্ড ফান্ডগুলিরও। অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে লগ্নিকারীরা এখন বেশ সঙ্কটে। দেশে সাধারণ নির্বাচন না-হওয়া পর্যন্ত সরকারে যেমন দুর্বলতা চলবে, তেমনই বড় লগ্নিকারীরাও তেমন ঝুঁকি নিতে চাইবে না। চিদম্বরম অভয় দিলেও পরিস্থিতি তিনি কী ভাবে সামলান তা-ই এখন দেখার।
অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, বার্নানকে-র বক্তব্যের একটু বেশি প্রতিক্রিয়া হয়েছে বাজারে। অর্থাৎ খানিকটা হয়তো শোধরাবে বাজার। বৃহস্পতিবারের সুনামির পর শুক্রবারই সবুজে ফিরেছে শেয়ার বাজার। সবারই প্রার্থনা, সূচক যেন এই জায়গা থেকে আর নীচে না-যায়!
|