আমরা যে জলসা ঘরে
প্লেব্যাকের সুযোগ আর সিডির বিক্রি কমছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিডির দোকানও।
অনুষ্ঠানগুলোই কি বাঁচিয়ে রাখবে কণ্ঠশিল্পীদের? খোঁজ নিলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি।
তার পর পার্ক স্ট্রিট মোড়টাই যেন কেমন অন্য রকম দেখতে হয়ে যাবে।
মিউজিক ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সিডি বিক্রির চলটা দিন দিন কমে আসছে।
শ্রোতারা গান শুনছেন না তা নয়, কিন্তু সবই নাকি ডাউনলোড! আর বাদবাকি সস্তা দরে ফুটপাত থেকে কেনা পাইরেটেড সিডি। ও দিকে সিনেমার প্লেব্যাকেও তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে। সুরে না গাইতে পারলেও, টেকনোলজি দিয়ে গলা ঠিক করে সিনেমার গান গাওয়ানো হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে সুরকাররাই গান গেয়ে দিচ্ছেন সিনেমাতে।
আর এ সবের মধ্যে হঠাৎ ‘ঝলক দিখলা যা’র মঞ্চে শান গান ছেড়ে ঝকমকে পোশাক পরে নৃত্যের তালে তালে মেতে উঠেছেন। সদ্য বিয়ে করেও পটা চলে গিয়েছেন ‘বিগ বস’-এর বাড়িতে। স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হয়ে থাকবেন তিন মাস তিনি!
তা হলে কি এ কথা মেনে নিতে হবে যে গায়ক হয়ে সিনেমায় প্রচুর গান গাওয়ার স্বপ্নটা ক্রমশ যেন মরীচিকা হয়ে উঠতে চলছে? সিনেমার গান
নেই। সিডির বিক্রি নেই। শো আর বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল ছাড়া কি আমরা আর কোনও বিশেষ জায়গা দিতে পাব না আমাদের কণ্ঠশিল্পীদের?
|
|
এ প্রশ্নের উত্তর নেই
শ্রীকান্ত আচার্য
যত দিন যাচ্ছে আমরা ফিজিক্যাল থেকে নন-ফিজিক্যাল ফরম্যাটে চলে যাচ্ছি। সিডির বিক্রি কমে যাচ্ছে। আমাদের দেশে সাইবার আইন আরও শক্ত করাটা জরুরি। আজ কি কেউ ভাবতে পারেন যে একটা বিষয় ভেবে কিছু গান রেকর্ড করে একটা সিডি বানিয়ে তার বিশাল বিক্রি সম্ভব? টাকা খরচ করে যদি কেউ সিডি বানায় আর তা যদি বিনামূল্যে ডাউনলোড হয়ে যায়, তা হলে
আর সেই টাকাটা খরচ করার মানে কী? এটা ঠিক যে এ রকম পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠানের উপরেই একজন গায়কের কেরিয়ার নির্ভরশীল। অ্যাড জিঙ্গলস গেয়েও যে অনেক অনেক টাকা রোজগার করা সম্ভব, তাও হয়তো নয়। সত্যি বলতে কী এখানে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সত্যি তার উত্তর এখন অনেকের কাছেই নেই। |
|
|
এক বছরের মধ্যে হয়তো বদল হবে
রূপঙ্কর
কনসার্টই হচ্ছে রোজগারের মূল জায়গা। তাও সারদা কেলেঙ্কারির পর কনসার্টের
বাজারটাও একটু খারাপ চলছে।
যদিও আমি মনে করি এটা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে। তবে আমি যে সব প্লেব্যাক আর জিঙ্গলের কাজ করি, তা নিয়ে বেশ খুশি। কিন্তু এটাও স্বীকার করছি যে আমরা এখন একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। চারদিকে অস্থিরতা চলছে। কলকাতাতে অত না হলেও, বলিউডে এখন অনেক বেসুরো গায়কদের দিয়েই গান গাওয়ানো হয়ে থাকে। সুরকাররা নিজেরাই গান গাইছেন। আর ডি বর্মনও গান গাইতেন নিজের সুরে। কিন্তু সব গানই নিজে গাইতে চাইতেন না। তবে আশা রাখি, আগামী দু’বছরের মধ্যে বদল আসবেই। যাঁরা ঠিকঠাক কাজ করতে পারেন, তাঁদের জায়গা থাকবেই। |
|
|
আমি চার বছর আগেই এটা বলেছিলাম
বাবুল সুপ্রিয়
আমি চার বছর আগেই এই
কথাগুলো বলেছিলাম। আমি জানতাম যে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বেসিক গায়কদের জায়গাটা আস্তে আস্তে কমে আসছে। যে কেউ পিচ কারেকশন করে গান রেকর্ড করতে পারেন। কোনও পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক আজ আর অপরিহার্য নন। কিন্তু এ সব নিয়ে হতাশায় ভুগে অভিযোগ করার কোনও জায়গা নেই। আজ বলতে দ্বিধা
নেই যে আমি কিন্তু প্রচুর শো করেছি। মাঝখানে একটা সময় এসেছিল যখন এই শোগুলো রোজকার গায়কদের বদলে ‘এক-দু’টো হিট’ দেওয়া নতুন গায়কদের কাছে যাচ্ছিল। কিন্তু লাইভ পারফমেন্সের সময় দেখা গিয়েছে যে, এরা কিন্তু একটা-দু’টো হিটের বাইরে আর তেমন কিছু গাইতে পারছেন না, যা দিয়ে দু’ঘণ্টার একটা ভাল অনুষ্ঠান করা সম্ভব। তাদের মধ্যে কিছু ভাল গায়কও আছে। তবে এখন আবার রেগুলার গায়কদের কাছেই শো ফিরে আসছে। নতুনদের উচিত নিজেদের এমন একটা ব্র্যান্ড তৈরি করা, যা দিয়ে তারা যেন বিশ্বব্যাপী শো করার চাহিদা তৈরি করতে পারে। |
|
|
আগেও অনুষ্ঠানভিত্তিকই ছিল
শুভমিতা
এটা ঠিক যে কণ্ঠশিল্পীদের রোজগার অনুষ্ঠান থেকেই আসে। জিঙ্গলসও আগের থেকে অনেক কমে গিয়েছে। আর প্লেব্যাক তো বছরে দু’টো কি তিনটে। গান হয়তো অনেক রেকর্ড হচ্ছে, তবে সেগুলো ঠিকমতো কি মুক্তি পাচ্ছে সব সময়? সিডি বিক্রি কমে গিয়েছে। ক্যাসেট কোম্পানিগুলোকে ভাবতে হবে, কী ভাবে তারা ডিজিটাল ফরম্যাটে কাজ করতে পারে। তবে লোকে যে গান শুনছে না, তা নয়। বাংলাদেশে গাওয়া আমার একটা গানের অনুরোধ আমি প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে পাই। সে গানটা কিন্তু এ দেশে রিলিজ করেনি। নিশ্চয়ই ইউ-টিউবে শুনে শ্রোতাদের এত ভাল লেগেছে যে, তাঁরা সেটা অনুষ্ঠানেও শুনতে চান। আর একটা কথা। অনুষ্ঠান ভিত্তিক রোজগার কিন্তু আগেও ছিল। নচিদার (নচিকেতা চক্রবর্তী) অ্যালবাম হয়তো গোল্ড ডিস্ক হয়েছে। তবু কি উনি শো করেননি? আমি সন্ধ্যাদিদের আমলের কথা বলতে পারব না। তখন হয়তো রয়্যালটির টাকা অনেক বেশিই পেতেন শিল্পীরা। |
|
|
বাচ্চাদের এই সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত
লোপামুদ্রা মিত্র
আমি এইচএমভিতে কাজ করেছি বলে এখনও খানিকটা রয়্যালটি পাই। কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে আমার কেরিয়ারটাও তো শো-এর উপর নির্ভর করে। এবং এটা সকলের ক্ষেত্রেই ঠিক। এত শো যদি না করতাম তা হলে হয়তো আমার গলাটা আরও কিছু বছর বেশি ভাল থাকত। বেশি শো করলে তো গলার ডিজেনারেশন হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, ট্যালেন্ট হান্টের প্রতিযোগীদের এই বিষয়ে সচেতন করাটা দরকার। আর প্রতিযোগীদের অভিভাবকদেরও এটা জানা দরকার। ভুল স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা উচিত নয়। তাসের ঘর এক দিন ভাঙবেই। ট্যালেন্ট শোতে একটা বাচ্চাকে যদি বলা হয় যে সে এ ভাবে রেওয়াজ করে গেলে একদিন প্লেব্যাকে খুব নাম করবে, তা হলে একদিন তার স্বপ্নভঙ্গ তো হবেই। কাউকে এমন স্বপ্ন দেখিয়ো না, যেখান থেকে পড়লে একেবারে পঙ্গু হয়ে যাবে। মাটিতে পা রেখে চলাই ভাল। |
|
|
একটা প্লেব্যাক গাইলে মাত্র দশ হাজার টাকা পাওয়া যায়
মনোময় ভট্টাচার্য
গায়করা কিন্তু চিরকালই অনুষ্ঠানের উপরেই ভরসা করে এসেছেন। রেডিয়ো চ্যানেল বেড়েছে। তাতে গানও বাজানো হচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পীর নামটাও বলা হয় না। কলকাতায় রেডিয়ো বুম এসেছিল ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত। কিন্তু এখন আর তেমনটি নেই। প্রায়ই শুনি কেউ না কেউ বলছেন, “দাদা, কাল একটা গান শুনলাম। বেশ ভাল লাগল”। জিজ্ঞেস করি কোথায় শুনলেন? কোন অ্যালবাম থেকে? উত্তর নেই। আর প্লেব্যাক? ক’টা ছবিতে আর প্লেব্যাক করতে হয় বাংলার শিল্পীদের? আর যদিও বা হয়, একটা গান গাইলে তো মোটে দশ হাজার টাকা পাওয়া যায়। সেটা তো হাতের ময়লা। তা দিয়ে একটা লাইফস্টাইল চালানো যায় নাকি? এ কথা আজকের দিনে মেনে নিতেই হবে যে, গায়কদের জীবন যাপনের একমাত্র উপায় হচ্ছে শো। |
|
|
|