|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
চানাচুর থেকে কাঞ্চন
আশুতোষ কলেজের পাশে নিঝুম দুপুরে নিঃসঙ্গ ক্যাফে-তে স্মৃতির ঝাঁপি
উজাড় করে দিলেন কাঞ্চন মল্লিক। শুনলেন তাপস সিংহ |
|
ওই পান-সিগারেটের দোকানের বাইরে যে ছেলেটা হলুদ গেঞ্জি গায়ে এই রোদে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে নিজের কথা মনে পড়ছে না?
বড় অদ্ভুত প্রশ্নটা করলেন! আমিও ঠিক ওই কথাটাই ভাবছিলাম। নিজেকে ওই জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললাম, ওহে কাঞ্চন, ছেলেটাকে মনের মধ্যে জাগিয়ে রেখো। ওর এই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টটাকে ভুলে যেয়ো না। একটা ব্র্যান্ডের সিগারেট বেচছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। খদ্দের এলে দৌড়ে গিয়ে বলছে, ‘এক বার এই সিগারেটটা ট্রাই করে দেখবেন স্যর?’
কিন্তু এখন, বড় গাড়ির টিনটেড গ্লাসের ও-পারে থাকা ওই ছেলেটার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এই লোকটা এ কথা বললে মনে হয় না, বড় সাজানো, পমেটম মাখানো কথা?
সত্যি বলছি, হয় না। আমি যে দীর্ঘ কাল ওই কাজটাই করেছি! মার্কেটিং এজেন্সির হয়ে কোনও দিন চানাচুর, কোনও দিন কাপড় কাচার সাবান, আবার কোনও দিন ভেজিটেবল তেল বেচেছি বাড়ি বাড়ি। লোকে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বিরক্ত হয়ে বলেছে, লোককে উত্ত্যক্ত করা ছাড়া কাজ নেই?
কী মনে হত তখন?
দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে বলতাম, কাঞ্চন, লড়াইয়ের মাঠ থেকে পালিয়ে যেও না। দিনভর খাটলে তবে ৪০ টাকা পাবে। তোমার মুখের দিকে চেয়ে আরও পাঁচটা মুখ। বাবা-মা, ঠাকুর্দা-ঠাকুমা আর বোন। ঠাকুর্দা-ঠাকুমা তখনও বেঁচে।
চানাচুর বেচা কাঞ্চন মল্লিক কী করত তখন? লোকে তাড়িয়ে দিলে?
তাঁদের বলতাম, ফিরিয়ে দিচ্ছেন তো? সন্ধেবেলায় চা খাওয়ার সময় আফশোস হবে কিন্তু! তাঁরা বহু সময় অবাক হয়ে বলতেন, কেন? বলতাম, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, চায়ের সঙ্গে কোনও সময়েই কি চানাচুর খান না? এক বার আমার থেকে নিয়ে দেখুন, ঠকবেন না, ফের ডাকবেন।
এখন তো কাঞ্চন কিছু বললে লোকে হাসে! ও সব কথা বলার পরে তখন কী করত?
বেশির ভাগ সময়েই সাকসেসফুল! নেবে না মানে? আমার মতো বেচুবাবু পাবে কোথায়? আরে, শুধু কি চানাচুর? মদের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে কোলা-ও বেচেছি।
আশুতোষ কলেজের পিছনে হাজরা রোডের সেই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে আজকের নাকতলার ফ্ল্যাট, সে দিনের বেচুবাবু আজকের কাঞ্চন মল্লিক। এই দীর্ঘ পরিভ্রমণ কি শেষ হয়ে গেল?
কী ভাবে তা শেষ হতে পারে? কত ইনিংস যে বাকি! কত ভাল ভাল কাজ করা বাকি! |
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
জীবনই তো মানুষকে ঘাড়ে ধরে শেখায়, এগিয়ে চলার পথও দেখায়। আপনি কী শিখলেন?
দৌড়নোর সময় কেউ অত ভাবে না। হাজরা রোডের যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, তার বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝামেলা ছিল। ১৮-১৯ বছর ধরে সেই বাড়ির জলের লাইন কাটা ছিল। বাইরে থেকে জল টেনে আনতে হত। ২০০৫-এ নাকতলায় নিজেদের ফ্ল্যাটে যখন এলাম, মা এসে প্রথমে কী বলেছিল জানেন? বলেছিল, হ্যাঁ রে, কল থেকে একসঙ্গে এত জল পড়ে!
হাজরা রোডের বাড়িতে তো বোনও ছিল?
হ্যাঁ, ছিল। আর নেই। মাত্র ৬ বছর বয়সে ও মারা যায়। ওর হৃদ্পিণ্ডের ভাল্ভ খারাপ ছিল। আমি ওর থেকে ১৪ বছরের বড়। জীবনের কথা বলছিলেন না? তা সেই জীবন শিখিয়ে দিল প্রিয়জনের মুখাগ্নি কী ভাবে করে। বাবা সেই ’৮৬ সাল থেকেই চোখে দেখেন না। বোন মারা যাওয়ার পরে বাবা বলত, ‘ওরে, বাড়ি থেকে বেরোস না, মেরে দেবে।’ কী করব? আমি না বেরোলে ওরা খাবে কী? রাতে সাউথ সিটি-তে কমার্স নিয়ে পড়ি। সকালে কাজ করি, বেচুবাবু!
দশ ফুট বাই দশ ফুটের এই কাহিনির নায়কের মাথা তা হলে ছাদ ফুঁড়ে আকাশ ছুঁল কী ভাবে?
রাতে বাড়ি ফেরার পরে অবসাদ গ্রাস করত। সেই ক্যাম্প খাট...দীর্ঘ রাত...পর দিন সকালে আবার বেচুবাবু হয়ে দোকানে দোকানে...বাড়িতে বাড়িতে...। সন্ধ্যায় আড্ডা মারতাম বন্ধুদের সঙ্গে। আমি কালীঘাটের রকে বসা ক্যাওড়া ছেলে তো! থিয়েটার-ফিয়েটার নিয়ে অত মাথা ঘামাইনি আগে। তা সেই সময়ে, সেটা ’৯০ সাল হবে। এক বন্ধু শ্রীপতি ভট্টাচার্য নিয়ে যায় অভিনেতা-নাট্যকার শ্যামল সেনের (কৌশিক সেনের বাবা) বাড়িতে। কৌশিকের সঙ্গে আলাপ তখন থেকেই।
থিয়েটার নিয়ে আগে মাথা না ঘামালেও পরে তা হলে গেলেন কেন ওখানে?
আরে বাবা, সন্ধের পরে তেমন কিছু করার ছিল না। বাজে কাজে সময় নষ্ট না করে ভাবলাম, অভিনয়ে মন দিই। দলের কাজ করব, সময়টাও ভাল কাটবে। এক ধরনের পালানোও বলতে পারেন। তা সে সময় শ্যামলকাকুর সঙ্গে রোজ আড্ডা মারতাম। কত কিছু যে বলতেন, কত জটিল বিষয়ই যে অত্যন্ত সহজ করে আমার ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। এই ভাবে ধীরে ধীরে ‘স্বপ্নসন্ধানী’র শুরুর দিন থেকেই এই দলের এক জন হয়ে উঠলাম। দীর্ঘ টানা সাত বছর আমি দলের সম্পাদক ছিলাম।
গ্রুপ থিয়েটারেও তো ‘আমরা-ওরা’ ভাগ আছে?
আছেই তো। যারা কাঁধে করে ম্যাটাডরে সেটের মাল তোলে, যারা পুরসভায় অনুমতির জন্য দৌড়য়, আপনাদের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে যায়, তারা কেউ কিন্তু ‘ওরা’ নয়, ‘আমরা’। এই ‘আমরা’ টিভি চ্যানেলে মুখ দেখাতে পারে না, গ্ল্যামার তাদের পিছু পিছু ছোটে না। ‘ওরা’ কিন্তু আলাদা শ্রেণিভুক্ত! এই জন্যই গ্রুপ থিয়েটারের চেনা স্লোগান: ‘ভাইদের ঘাম, দাদাদের নাম।’
আপনি কি কারওর বা কারওদের দিকে আঙুল তুলছেন?
একেবারেই নয়। আমি পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করছি মাত্র!
আপনি তা হলে কোন দলে? ‘ওরা’ না ‘আমরা’? ‘আমরা’। আগে যা করতাম, এখনও তা-ই করি। শুধু আমি একা নই, আরও অনেকেই তাই। এই তো, আমাদের দলের রবি, মানে রবীন্দ্রনাথ জানার কথাই ধরুন না। বিয়ের পরে ফুলশয্যার রাত কাটানোর আগেই খাটের তলা থেকে বাক্স বার করে নতুন বৌকে বলল, ‘চললাম গো, কল শো আছে!’ এই রবি, শুভাশিস সেনগুপ্ত, রেশমি সেন-রা কিন্তু সংখ্যায় অনেক!
সত্তরের দশকে ভারতীয় ক্রিকেট টিমে একনাথ সোলকার ফিল্ড করতেন ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে। তাঁর নাম নিশ্চয়ই জানেন?
জানি তো! দুর্ধর্ষ ফিল্ডার! কিন্তু হঠাৎ তাঁর প্রসঙ্গ?
বেদী-প্রসন্ন-চন্দ্রশেখর— এই স্পিনার ট্রায়োর ঝুলিতে অনেক উইকেটই জমা পড়ত না যদি না সোলকার ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে থাকতেন। অজস্র হাফ চান্সকে তিনি তালুবন্দি করেছেন! অথচ, ভারতীয় দলের ড্রেসিং রুমে তাঁর তেমন ওজন ছিল না। মালির ছেলে, বংশকৌলিন্য বলে কিছু নেই, আভিজাত্য নেই, অথচ, সোলকার ছাড়া চলবেও না! আচ্ছা, আপনার কি কখনও কখনও দলে নিজেকে একনাথ সোলকার বলে মনে হয়?
(অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে) মাঝে মাঝে মনে হয় বইকী! এটাও তো একটা লড়াই! সেই লড়াই থেকেই তো ২০০৪-’০৫ সালে দলে ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, দলের পরিবেশ আমার সঙ্গে যাচ্ছে না! কেউ বা কারা কুৎসা করছিল বাবানের (কৌশিক) কানে। বলছিল, আমি দলের অস্বস্তির কারণ হচ্ছি। কিন্তু, দু’বছর পরে বাবান ফোন করে বলে, ‘তুই দলে চলে আয়।’ থিয়েটারকে ভালবাসি, চলে এলাম আবার!
‘স্বপ্নসন্ধানী’তে থাকার সময় আর কী করতেন?
আরে, সে সময় আমি এলগিন রোডে একটা বিখ্যাত পার্লারে ম্যানেজারের কাজ করি। সেখানে উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও চুল কাটতেন। যদিও উত্তমকুমারকে আমি দেখিনি। দেখার কথাও নয়। মাইনে পেতাম বারোশো টাকা। কিন্তু অভিনয়ের নেশা তত দিনে ঘাড়ে চেপে বসেছে। ওই পার্লারে ছিলাম ’৯৩ থেকে ’৯৮ সাল পর্যন্ত।
ছোট পর্দায় আপনি প্রথম সাড়া জাগান ‘জনতা এক্সপ্রেস’ করে। শুনেছি, আপনি যেখানে যেতেন, লোকজন পাগলের মতো ছুটে আসত।
হ্যাঁ, এমনও হয়েছে, আমি শু্যটিং করেছি পুলিশি পাহারায়। থানার ওসি দাঁড়িয়ে থেকেছেন। সে কী অবস্থা! অথচ, তখন প্রতি এপিসোডের জন্য আমার পারিশ্রমিক কত ছিল জানেন? মাত্র পাঁচশো টাকা। তখন তো আমার চাকরিও নেই। ছেড়ে দিয়েছি।
আচ্ছা, এই যে একটা লোক চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াল...দশটা-পাঁচটার কথা ভাবল না...ওই পেটগুলোর কথা...এত সাহস কোথা থেকে পায় এক জন?
জানি না তো! অত ভাবিনি যে! মনে হয়েছিল, কিছু একটা নিশ্চয় হবে। পারব না? নিশ্চয় পারব! ঝাঁপিয়ে পড়লাম! ধীরে ধীরে টালিগঞ্জ পাড়া চিনলাম।
এখনও তো কত অজস্র মুখ এই টলিউডের ইতিউতি ঘুরে বেড়ায়। দেখা হলে বলে, ‘কাঞ্চনদা, একটু দেখবেন প্লিজ!’ কী বলেন সেই মুখগুলোকে?
সাধ্যমতো চেষ্টা করি ওদের জন্য। পরিচালক বন্ধুদের বলি, এক বার সুযোগ দিয়ে দ্যাখো। কেউ যখন আমাকে বলে, একটু দেখবেন, তখন বুঝি, সে অনেকগুলো দেওয়াল ভাঙতে ভাঙতে এসেছে। তাই এ কথা বলছে। নিজেকে রোজ যা বলি, ওদেরও তাই বলি। বলি, নিজের কাজে আর একটু সিরিয়াস হও। কোনও পাবলিক রিলেশন লাগবে না। সুযোগটাকে ঠিক ভাবে কাজে লাগাও। দেখবে, ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও না কোনও ছাতা তোমার মাথা খুঁজে নেবে!
আর সেই হলুদ টি-শার্ট পরা ছেলেটা? টালা থেকে টালিগঞ্জ, যে ছিল বেচুবাবু? রোদে পুড়তে পুড়তে বৌবাজার মোড়ের পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা? ফুটের ধারে দাঁড়িয়ে মুখে-চোখে জল দিতে দিতে কাস্টমার দেখেই দৌড়ে যাওয়া ছেলেটা? সে যদি আজ সামনে এসে দাঁড়ায়? জিগ্যেস করে, আমায় কিছু বলবে না?
পয়সা বাঁচাতে বঙ্গবাসী কলেজের পাশে ভিখারিদের হোটেলে খেতাম। এলগিন রোডে একশো গ্রাম করে ছাতু খেতাম, অনেকক্ষণ পেটে থাকবে বলে। আর বেশি বেশি করে চা খেতাম, খিদে মরে যাবে বলে! ওকে বলব, খিদেটা মার ছোট ভাই, স্বপ্নটাকে মারিস না! |
|
|
|
|
|