|
|
|
|
মাধবীলতার ফিরে দেখা
মঞ্চে অভিনেত্রীর চরিত্র করে প্রশংসা পাচ্ছেন অনসূয়া মজুমদার।
কাজের ফাঁকে নিজের অভিনয় জীবনের গল্প করলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্তর সঙ্গে |
প্রথম যে দিন তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে তিনি দেখা করতে যান, সে দিনের কথা আজও তাঁর স্পষ্ট মনে আছে। যিনি তাঁকে আলাপ করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি বলেন: “বৌদি, ওর একটা সমস্যা আছে। ও বাংলা লিখতে-পড়তে জানে না!” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এসেছিল: “ওমা, অভিনয় করবে কী করে?” বছর পঁচিশের মেয়েটি কিন্তু থেমে থাকেনি। এগিয়ে গিয়েছে শুধু তাঁর অভিনয় করতে চাওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাস নিয়ে।
এখন শহরে একটার পর একটা হাউজফুল শো চলছে তাঁর। এক অভিনেত্রীর চরিত্র করছেন অনসূয়া মজুমদার। ব্রাত্য বসুর ‘সিনেমার মতো’ নাটকে। মঞ্চের অভিনেত্রীর পাঠ থেকে একটু ছুটি নিয়ে ফিরে দেখতে কেমন লাগে পুরনো সেই দিনগুলো?
বৌদি বলেছিলেন শাঁওলির রোলটা দেখে রাখতে
ছোটবেলা কেটেছে ধানবাদে। স্কুলে বাংলা শেখার উপায় ছিল না। ‘বহুরূপী’তে যোগ দেওয়ার পরে সব সময় খেয়াল রাখতে হত, কথা বলতে বলতে হিন্দি বা ইংরাজি শব্দ বেশি চলে না আসে। মনে পড়ে যায় বাদল সরকারের ‘যদি আরেকবার’ নাটকটির কথা। সে সময় শাঁওলি মিত্র নাটকটিতে বনলতার চরিত্রে অভিনয় করতেন। “বৌদি (তৃপ্তি মিত্র) এসে বললেন, ‘শাঁওলি যে রোলটা করছে সেটা একটু দেখে রেখো’। হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাকে সেই চরিত্রটি করতে হবে,” অনসূয়া জানান। ভাবতে থাকেন নতুন কী করা যায়। একটা দৃশ্যে ছিল যে তাঁর চরিত্রটি, প্রেমিকের সঙ্গে গল্প করছে। “ঠিক করলাম ওই দৃশ্যে চোখের পাতা পিটপিট করব। তা হলে একটু আলাদা হবে। এটাও মনে আছে শো-য়ের দিন সকালে শাঁওলি এক ঘণ্টা ফোনে আমাকে রোলটা নিয়ে, আর বাকি যা দরকার, বুঝিয়ে দিয়েছিল। যে মেয়েটি ওকে সাহায্য করত, তাকেও আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল,” বলেন তিনি।
আর তার পর পথ চলা শুরু। খানিক দূর গিয়ে ‘বহুরূপী’ ছেড়ে দেওয়া। “আমি নাচের দিকে মন দেব বলে ‘বহুরূপী’ ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭৮/৭৯ নাগাদ আমাকে দলে ফিরে আসার জন্য আবার অনুরোধ করা হয়। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে বসন্তসেনার চরিত্রটি করার জন্য। প্রায় ৩২টা ভাল শো-য়ের পরে আমি ‘বহুরূপী’ ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। ভীষণ খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল, আই ওয়াজ ইউজড। ক্রাইসিসের সময় আমাকে ডেকে নিয়ে এসে অভিনয় করানো হয়। কিন্তু সে নিয়ে আজ আর কোনও ক্ষোভ নেই। বরং এতে আমার সুবিধাই হয়েছে। অভিনেত্রী হিসেবে আমি অনেক ভাল করেছি,” বলেন তিনি।
চাকরি বনাম অভিনয়
কথার ফাঁকে হাসতে হাসতে বলেন তিনি নাকি ছিলেন ‘উইকএন্ড অভিনেত্রী’। একটি বড় কোম্পানির ডিরেক্টরের এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ৩১ বছর কাজ করেছেন। সে সময়ে থিয়েটারে পয়সা কই? চাকরি ছেড়ে ফুলটাইম অভিনয় করার কথাও তখন মাথায় আসেনি। |
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
তবে চাকরি সামলেও নাটক, সিরিয়াল, সিনেমা করা চালিয়ে গিয়েছেন। “মৃণাল সেনের ‘মহাপৃথিবী’ করেছি। মৃণালদা বলতেন তোমার কাজ সেরে তার পর জানিও, কখন শ্যুটিং করলে সুবিধা হবে। সে অনুযায়ী কলটাইম রাখা হত। চরিত্রটা দেওয়ার আগে বলেছিলেন আমারটা মেন পার্ট নয়, বেশি সংলাপও নেই চরিত্রটিতে। পরে শুনলাম প্রায় একদমই ডায়লগ নেই। শুনে আমি মৃণালদাকে বলেছিলাম ‘আরও ভাল’। খুশি হয়েছিলাম সাইলেন্ট অ্যাক্টিং করার সুযোগ পাব ভেবে,” বলে চলেন তিনি।
আজও তিনি মাধবীলতা
তবু এত কাজের মধ্যে আজও অনেকেই তাঁকে মনে রেখেছেন মাধবীলতা হিসেবে। রাজা দাশগুপ্তের সিরিয়ালে প্রথম যখন অভিনয় করার প্রস্তাব আসে, তখনও বইটি পড়েননি। “শুনেছিলাম যে মাধবীলতার পাঠটা অন্য অভিনেত্রীকে দেওয়া হয়েছিল। আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। আই হ্যাভ টু বি ন্যাচারাল। তাই হয়তো অনেকেই আমার অভিনয়ের সঙ্গে নিজেদের আইডেন্টিফাই করছিলেন। তখন টেলিভিশনে কাজের ধরনটা আলাদা ছিল। দু’দিনে হয়তো একটা করে এপিসোড শ্যুট হত। ভাববার সময় পাওয়া যেত। এখন কাজের ধরনটা আলাদা। টিআরপি ব্যাপারটা চলে এসেছে। তবে সব সময় মাথায় রাখি, যদি একজন দর্শকও আমার কাজটা দেখেন, তিনি যেন খুশি হন।” তবে পাওলির মাধবীলতা দেখা হয়নি! যদিও পাওলিকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল তাঁকে মাধবীলতার চরিত্রে মানাবে।
অনুশোচনা কি নেই
অরুন্ধতীদেবী সম্পর্কে পিসি হন। তপন সিংহ যখন ‘হুইলচেয়ার’ বানাচ্ছিলেন সেখানে একটা ছোট চরিত্রে করার কথা হয়েছিল। “সম্পর্কে তপনবাবু আমার পিসেমশাই। কিন্তু দেখা করার পর স্পষ্ট বলেছিলেন যে চরিত্রে তেমন কিছু করার নেই। সেটা জেনেও আমি করব কিনা। জানতাম যে চরিত্রটি না করলে উনি কিছু মনে করবেন না। আমি চরিত্রটি করিনি,” বলেন তিনি।
কথায় কথায় বললেন কী ভাবে একবার সত্যজিৎ রায়কে চিঠি লিখেছিলেন। “উত্তরে উনি লিখেছিলেন সে সময়ে ওঁর ছবিতে আমার জন্য কোনও পাঠ ছিল না। পরে যখন ‘কালপুরুষ’ সিরিয়ালটি করি তখন আবার চিঠি বিনিময় হয়। প্রথমে সম্বোধন করতেন ‘মিসেস মজুমদার’ বলে। পরে ‘অনসূয়া’ বলেই চিঠি লিখতেন। উনি বলেছিলেন যে অনেকেই ওই সিরিয়ালে আমার কাজের প্রশংসা করছেন। কিন্তু উনি আমার এপিসোডগুলো মিস করে গিয়েছেন। ভেবে ভাল লাগে যে আমাদের একবার দেখাও হয়েছিল,” তিনি জানান।
ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’য়ে কাজ করার কথা হয়েছিল। না, অপর্ণা সেন বা দেবশ্রী রায়ের অভিনীত চরিত্রগুলোতে নয়। কিন্তু কাজটা করে ওঠা হয়নি। পরে ‘বাহান্ন এপিসোড’, ‘চিত্রাঙ্গদা’য় অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথের উপর ঋতুপর্ণর ডকুমেন্টারিতেও ভয়েসওভার করেছেন।
মুম্বইতে যাওয়া হল না ভয়ে
থিয়েটার অনসূয়ার প্রথম প্রেম ছিল। আর নাচ ছিল দ্বিতীয় প্রেম। এই তো বছর দুই আগে স্যফায়ার ডান্স ট্রুপের একটি অনুষ্ঠানেও নাচলেন। কোনও দিন মুম্বই যাওয়ার কথা ভাবেননি কেন? “চাকরি ছেড়ে মুম্বইতে স্ট্রাগল করার সাহসটাই ছিল না। রিজেকশনের ভীতি ছিল। ক্রাইসিস চাইনি,” বলছেন তিনি। কোথাও কি একটা একটা অহঙ্কারও কাজও করত? চাকরির ‘সেফটি নেট’ থাকলে যেটা থাকে? “অলস হয়ে গিয়েছিলাম। সবই তো পাচ্ছিলাম। মৃণালদা, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সঙ্গেও কাজ করছি।”
ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকালে কেমন লাগে? “কাজ খুঁজব বলে ছুটে বেড়াইনি। মনে হত যে আমি যদি কাজ-কাজ করে ছুটে বেড়াই, তা হলে তো নিজের ক্রিয়েটিভিটিটাই নষ্ট করে ফেলব। সাত বছর আগে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছি। সিরিয়াল করা নিয়ে আমার কোনও ছুঁৎমার্গ নেই। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করাটা একটা আশীর্বাদ। ‘কোয়ান্টিটি’র দিক দিয়ে হয়তো বেশি কাজ করিনি। তবে ‘কোয়ালিটি’ অনুযায়ী সেগুলো বেশ ভাল। আমার ছেলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। এখন ওকে নিয়েই স্বপ্ন দেখি,” বলেন তিনি।
আর ‘সিনেমার মতো’ নাটক করাটাও একটা অসম্ভব ভাল অভিজ্ঞতা। “ব্রাত্যর টিমটাও খুব ভাল। অভিনেত্রীর চরিত্র বলে মাঝে মাঝে একটু অতিবাস্তব মনে হয় সব কিছু। তবে ভাবি নিজের কথা যদি এখন না বলি তো
কবে বলব?” |
|
|
|
|
|