কামদুনি-কাণ্ডের পর থেকে প্রায় প্রতিটি জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ওই ঘটনায় ১৫ দিনের মধ্যে পুলিশ চার্জশিট দেবে। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার করে এক মাসের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করা হবে। শনিবারই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো চার্জশিট জমা দেওয়ার শেষ দিন। কিন্তু এ দিন আদালতে তা পেশ করতে পারল না সিআইডি।
শনিবার এক সিআইডি-কর্তা বলেন, “কামদুনির ঘটনায় তদন্ত শেষ হয়ে গেলেও ফরেন্সিক রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। আশা করছি, আগামী সপ্তাহেই চার্জশিট জমা দেওয়া যাবে।” এবং সেই কারণেই বিচার প্রক্রিয়া এক মাসের মধ্যে শেষ করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পুলিশের একটি বড় অংশ।
অবশ্য প্রশাসনেরই অন্য একটি অংশ বলছেন, “অভিযুক্তেরা জেলে রয়েছে। তারাই মামলার মূল প্রত্যক্ষদর্শী। বিচার চলাকালীন বাইরের সাক্ষীকে হাজির করার প্রয়োজন নেই বলেই অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়া সম্ভব।’’
সময়ের মধ্যে সাজা হোক বা না হোক, এ রাজ্যে ধর্ষণের মামলায় কামদুনি ব্যতিক্রম বলেই মানছেন প্রশাসনের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের মামলায় এ রাজ্যের ছবিটা অন্য কথা বলছে। যেমন, বছর ঘুরে গেলেও কাটোয়ার ধর্ষণ মামলায় সাজা হয়নি অভিযুক্তদের।
যেমন ভাবে এখনও বিচার চলছে পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণ মামলারও। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র তথ্য বলছে, ধর্ষণের যত মামলায় চার্জশিট পেশ হয়েছে, সেখানে শাস্তির নিরিখে দেশের গড় হিসেবের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। এমনকী, যত দিন যাচ্ছে, শাস্তি দানের হার ক্রমশ কমছে এ রাজ্যে। যেমন, ২০০৮ সালে যেখানে শাস্তি দানের হার ছিল ১৫.২ শতাংশ, ২০১০-এ ১৩.৭ এবং ২০১২-তে আরও কমে দাঁড়িয়েছে ১০.৯ শতাংশে। এই হার অবশ্য কমেছে তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাতেও। |
শাস্তির হার |
|
দিল্লি |
৩৪.৬ |
৪১.৫ |
৪৯.৩ |
তামিলনাড়ু |
২৪.৩ |
২০.৪ |
২০.১ |
মধ্যপ্রদেশ |
২৮.২ |
২৩.৬ |
১৯.৫ |
গুজরাত |
১৭.৬ |
১৪.৭ |
১৫.৩ |
অসম |
১৮.১ |
২৩.৩ |
১৯.২ |
পশ্চিমবঙ্গ |
১৩.৭ |
১১.৫ |
১০.৯ |
* তথ্য সূত্র: নাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো |
কেন এই ব্যর্থতা |
• তদন্তকারী অফিসার কম • তদন্তের মান আশানুরূপ হচ্ছে না
• ১০টির বেশি মহিলা থানা হয়নি • সময় মতো চার্জশিট পেশ হচ্ছে না
• একটি মাত্র মহিলা আদালত • বিচার শুরু হতে দেরি হচ্ছে |
|
কেন এই হাল? একাধিক পুলিশকর্তার অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে ধর্ষণ মামলার চার্জশিট দেওয়া হলেও বিচার দেরিতে শুরু হয়। ফলে অভিযুক্তেরা জামিন পেয়ে যায়। পরবর্তী কালে সমন জারি করেও তাদের আদালতে হাজির করানো যায় না। সাক্ষীদেরও বিরূপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সর্বোপরি তদন্তকারী অফিসার বদলি হয়ে যাওয়ায় বিচারপর্ব শেষ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ বলছে, ২০১২-তে এ রাজ্যে ৯৬.২ শতাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণ মামলার চার্জশিট হলেও সেই তুলনায় শাস্তির হার বেশ কম। রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য অবশ্য পুলিশের এই অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন।
তাঁর বক্তব্য, “সম্প্রতি তিনটি ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ হয়েছে খুবই দ্রুত। অভিযুক্তদের শাস্তিও হয়েছে। মহিলাদের উপরে অত্যাচার সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি করতে সরকার রাজ্যে মোট ৪৫টি মহিলা আদালত তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
আইনমন্ত্রী যা-ই বলুন, এ পর্যন্ত একটি মাত্র মহিলা আদালত চালু করতে পেরেছে রাজ্য সরকার। সেটি মালদহে। কিন্তু এখনও সেখানে কর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। পুরোদস্তুর কাজ চালু করতে শীঘ্রই আরও কর্মী দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মহাকরণের এক কর্তা।
তিনি জানান, রাজ্যে যে ৮৮টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট আছে, দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সেখানেও মহিলাদের উপরে অত্যাচার সংক্রান্ত মামলা স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। কিছু দিন আগে পর্যন্ত সেখানেও বিচারক কম ছিল। আইনমন্ত্রী অবশ্য বলেন, “এখন আর বিচারকের অভাব নেই। আমরা সব পদ পূরণ করে দিয়েছি।”
এই পরিস্থিতিতে প্রতি মহকুমায় একটি করে মামলা তদারক কমিটি (ট্রায়াল মনিটরিং কমিটি) গঠন করেছে রাজ্য প্রশাসন। এক পুলিশকর্তা বলেন, “জেলা সদরে এক জন ইনস্পেক্টরকে ‘নোডাল অফিসার’ করে কমিটি তৈরি করেছেন এসপি-রা। তাঁরাই বিভিন্ন মামলার তথ্য জোগাড় করে রোজ রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন মহাকরণে।”
কিন্তু দ্রুত তদন্ত শেষ করার বন্দোবস্ত না করে তদারক কমিটি গঠনে কতটা লাভ হবে, প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশেরই একাংশ।
তাঁদের বক্তব্য, অভিযুক্তের সাজা পাওয়ার বিষয়টি যেমন অনেকটাই আদালতের উপরে নির্ভর করে, তেমনই পুলিশকেও আটঘাট বেঁধে নথি তৈরি করতে হয়। আদালতের দোরগোড়ায় মামলা পৌঁছে দেওয়ার পরেও সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ যাতে পুলিশের বক্তব্যের পক্ষে যায়, সে দিকেও নজর দিতে হয় তদন্তকারীদের।
আর এখানেই সমস্যা জটিল হচ্ছে। কেন? এক পুলিশকর্তা বলেন, “ফৌজদারি মামলার তদন্ত করেন যাঁরা, সেই সাব-ইনস্পেক্টরের (এসআই) সংখ্যা দিন দিন কমছে। রাজ্যে যেখানে ৪৯৪৫ জন এসআই থাকার কথা, সেখানে আছেন ৩৬৪৫ জন। ফলে কোনও জেলায় গড়ে ৫০, কোথাও বা ৭০-এরও বেশি মামলা জমে রয়েছে একেক জন তদন্তকারীর হাতে। ফলে সব ক্ষেত্রে তদন্তের মান আশানুরূপ হচ্ছে না বলেই স্বীকার করছেন একাধিক পুলিশকর্তা।
সেই ভার লাঘব করতেই রাজ্যে ৬৫টি মহকুমায় একটি করে মহিলা থানা তৈরির কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যেখানে কেবল মহিলাদের উপরে অত্যাচার সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত হবে।
কিন্তু এ পর্যন্ত ১০টির বেশি চালু করতে পারেনি সরকার। কেন? স্বরাষ্ট্র দফতরের তথ্য বলছে, রাজ্য পুলিশে অনুমোদিত মহিলা কর্মীর সংখ্যা ৫৫১৯। অথচ সেখানে আছেন মাত্র ১৮৪৯ জন। এত কম পুলিশ নিয়ে পৃথক মহিলা থানা চালানো কার্যত অসম্ভব বলেই জানাচ্ছেন পুলিশকর্তারা। |