|
|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২... |
দ্য রুম অন দ্য রুফ |
রাসকিন বন্ড
|
ইস্কুলের পড়া শেষ করেই, দুটো ফাঁকা পকেট আর একটা জামাকাপড় ভর্তি তোরঙ্গ নিয়ে, ইংল্যান্ড চলে গেলাম। ভেবেছিলাম, ওখানেই বাকি জীবনটা কাটাব। জার্সিতে, মাসির বাড়িতে থাকতাম। আর সারা দিন সমস্ত অফিস আর দোকানে ঢুঁ মারতাম, কাজ আছে কি না খোঁজ নিতে। আমার বয়স তখন সতেরো, কিন্তু নিজের খাওয়া-থাকার জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে একটুও ভাল লাগত না, তার ওপর আমার আদর্শ চার্লস ডিকেন্স ও জ্যাক লন্ডন তাঁদের টিন-এজ থেকেই স্বাবলম্বী ছিলেন। চাকরি নিয়ে আমায় কখনও ভাবতে হয়নি, আমার মতে চাকরি পাওয়ার সেরা উপায় বস-এর কাছে সটান উপস্থিত হও, আর বলো সব কিছু করতেই তুমি রাজি: চা বানানো থেকে কোম্পানির ডিরেক্টরের হয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া। প্রথম চাকরি পেলাম একটা বিরাট মুদির দোকানে, তার পর সেটা ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলাম একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে, সেখান থেকে গেলাম জার্সি ইলেকট্রিক-এ, তার পর জার্সি সিভিল সার্ভিস-এর পরীক্ষা দিয়ে দুশো জনের মধ্যে চতুর্থ হয়ে, জনস্বাস্থ্য দফতর-এ কাজ পেয়ে গেলাম। কিন্তু এ সব চাকরি-বাকরি নয়, আমার মন তখন অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।
একটা উপন্যাস লিখেছিলাম ভারতে থাকতে আগের বছর যে ডায়েরিটা লিখছিলাম, সেটার ওপর নির্ভর করে। উপন্যাসটা ছিল অপরিণত, আবেগ-ভর্তি, কিন্তু আমি জার্সি-তে মাসির বাড়ির ছোট্ট চিলেকোঠায় বসে বহু রাত্তির জেগে বহু যত্নে সেটা শেষ করেছিলাম। লন্ডনে কয়েক জন প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছিলাম পাণ্ডুলিপি, সেখান থেকে ফেরতও এসেছিল, কিন্তু তৃতীয় এক প্রকাশকের কাছ থেকে আশার আলো দেখা গেল। সেই আলো দেখাচ্ছিলেন ডায়ানা অ্যাটহিল, একটি নতুন প্রকাশনার জুনিয়র পার্টনার। বহু দিন পরে ডায়ানা হয়ে উঠবেন খুব সফল লেখক ও সম্পাদক, কিন্তু তখন তিনি সবে তিরিশ পেরোচ্ছেন, আমার চেয়ে বছর পনেরোর বড়। তখন তাঁকে কেউই ভাল করে চেনে না।
জার্সিতে আমার কোনও বন্ধু ছিল না। এ তো আর আমার অ্যাদ্দিনের নিবাস দেরাদুন নয়, যেখানে ইচ্ছে হলে তুমি পাশের বাড়ির ছেলেটার সঙ্গে, বা একটা মাঠে ক্রিকেট খেলতে থাকা ছেলেপুলের সঙ্গে, বা দোকানে সিনেমা-হলে বাসে ট্রেনে, দিব্যি গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলতে পারো আর বন্ধু হয়ে যেতে পারো। জার্সিতে যে অফিসে কাজ করছিলাম, সেখানে সবাই খুব ভদ্র, সব কাজে সাহায্যের জন্য সবাই তৈরি। কিন্তু যেই অফিস ছুটি হল, সবাই যে যার মতো বেরিয়ে গেল। আমিও কী আর করি, একলা হাঁটতে শুরু করতাম মাসির বাড়ির দিকে।
হাঁটাটা পনেরো মিনিটের। কুড়ি মিনিট হাঁটলে পৌঁছনো যেত সমুদ্রের ধারে। আর শহরের মধ্যিখানে যে লাইব্রেরি, অফিস থেকে সেখানে হেঁটে যেতেও সময় লাগত ওই কুড়ি মিনিটই।
বই-ই আমার সেরা বন্ধু ছিল। আমি ওই লাইব্রেরিতে খুঁজে পেলাম রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ কবিতা আর নাটক, সুধীন ঘোষ-এর ‘দ্য ক্রেড্ল অব ক্লাউড্স’ একটি ছেলের সাঁওতাল পরগনায় বেড়ে ওঠা নিয়ে আশ্চর্য বই, আর রুমের গডেন-এর উপন্যাস ‘দ্য রিভার’, যার প্রেক্ষাপট হচ্ছে পূর্ব বঙ্গ (এখন বাংলাদেশ)। এইগুলো, আর অন্য অনেক বইও, আমায় বারবার নিয়ে চলে যেত ভারতে, যেখানে আমি এত দিন ছিলাম, আর আমার লেখাটাকেও খুব অনুপ্রাণিত করত, রং জোগাত, আর আমার ফেলে আসা বন্ধুরা সব্বাই হইহই করে ঢুকে পড়ত আমার উপন্যাসটায়, নতুন নতুন চেহারা নিয়ে। বইটার নাম দিয়েছিলাম ‘দ্য রুম অন দ্য রুফ’।
এর পর ‘দ্য রিভার’ সিনেমাটা এল। সেটা একটা অসামান্য সিনে-কবিতা, যার পরিচালনা করেছিলেন বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী ক্লদ রেনোয়া-র ছেলে, কিংবদন্তি ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়া। গডেন-এর উপন্যাসটার এমন অপূর্ব কাব্যিক রূপ আমার ভারতের জন্যে মনকেমন বাড়িয়ে দিল। ঠিক করলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যাব। কিন্তু গিয়েও, আমার পরিবার বা বন্ধুদের গলগ্রহ হয়ে তো বাঁচা চলবে না। একটা স্কুলছাত্রের ভার নেওয়া, আর এক জন বেকার যুবকের ভার নেওয়া দুটো কোনও ভাবেই এক নয়।
তাই আমি সমুদ্রের ধারটায় হাঁটতাম, জোয়ার আসা দেখতাম, আর ঢেউগুলোর দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতাম এক জন বিরাট লেখক হওয়ার, যাকে টাকার জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না। সমুদ্রটা ছিল নৈর্ব্যক্তিক, রাজকীয়। সে আমার একাকিত্বটাকে বাড়িয়ে দিত, কিন্তু অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, তার কাছে আমি আমার নিজস্বতা আর অন্যরকমত্বের কথাও শুনতাম, সেগুলোকে সত্যি বলে অনুভব করতাম।
একটা শনিবার বিকেলে, অফিসের পর সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেখি, ভাটার টানে জল পিছিয়ে গেছে বহু বহু দূর। আমি আমার সাঁতারের পোশাক পরে নিয়ে, মাইলটাক বালি আর পাথরের ওপর দিয়ে সেই পিছিয়ে যাওয়া জলের দিকে হেঁটে গেলাম। একটা বড় একলা পাথর দেখে, তার ওপর এসে পড়া হেমন্তের রোদ্দুরের মধ্যে, শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাঙল, জোয়ার আসছে, আমার চারিদিকে থইথই করছে জল। জল তখনও পুরোটা ওঠেনি, আমার পাথরটা ডুবে যায়নি, কিন্তু প্রবল বেগে জোয়ার আসছে ফুলেফেঁপে। আমি প্রাণপণ সাঁতরাতে লাগলাম। জল আমায় সাহায্যই করছিল, ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল পাড়ের দিকে, তবে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। পাড়ে পৌঁছে যখন পিছন ফিরে তাকালাম, আমার পাথরটার কোনও চিহ্নই নেই, পুরো ডুবে গেছে। হঠাৎ কেন যেন মনে হল, জনস্বাস্থ্য দফতরে এক সামান্য কেরানি হওয়া আমার নিয়তি নয়। বা হয়তো আমার অহং আমাকে এ রকম ভাবাল!
লন্ডন আমায় ডাকল। যেমন ডেকেছিল আমার ছেলেবেলার নায়কদের কপারফিল্ড, নিক্ল্বি, ডিক হুইটিংটন, জেমস বসওয়েল। ভারতে বসে চার্লস ডিকেন্স, জে. বি. প্রিস্টলে, সমারসেট মম বা পি. জি. উডহাউসের বইয়ে পড়া লন্ডনের সঙ্গে যুদ্ধ-পরবর্তী লন্ডনের মিল সামান্যই থাকবে জেনেও ভাবলাম, কপাল ঠুকে গিয়েই দেখি এক বার।
মনে হয় না আমার মাসি মেসো ও মাসতুতো ভাইবোনেরা খুব দুঃখিত হয়েছিল আমি চলে যাচ্ছি দেখে। আমি তাঁদের ঘাড়ে বসে খাচ্ছিলাম না বটে আমার মাইনের অর্ধেক সব সময় মাসিকে দিয়ে দিতাম তবে আমার ভাবগতিক ঠিক ওই পরিবারটিকে গৌরবান্বিত করছিল না, সকলেই বুঝতে পারছিল আমার ইচ্ছে আর কল্পনা অন্য একটা জগতে ঘোরাফেরা করছে।
এ বার আর সঙ্গে বিরাট তোরঙ্গ নিলাম না। একটা সস্তা সুটকেস কিনলাম, তাতে ভর্তি করে নিলাম বই, পান্ডুলিপি, আর কয়েকটা জামাকাপড়। দেরাদুনে ঠাকুমার বাড়িতে যে ‘পিক্উইক পেপার্স’টা পেয়েছিলাম, সেটাও নিলাম। জার্সিতে আবিষ্কার করা রিচার্ড জেফেরিস-এর ‘দ্য স্টোরি অব মাই হার্ট’ও।
লন্ডনে ঘটনাবহুল দু’বছর কাটিয়ে ভারতে ফিরেছিলাম। সুটকেসটা ভালই সার্ভিস দিয়েছিল। এখনও সেটা আমার কাছে আছে, ষাট বছর পরেও, পুরনো পাণ্ডুলিপি আর ডায়েরি সেখানে রাখি। আমার মতোই, সেটা একটু টাল খেয়ে গেছে, কিন্তু দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে।
আর এখনও সঙ্গে রয়েছে ‘পিক্উইক পেপার্স’ ও ‘দ্য স্টোরি অব মাই হার্ট’। |
(লেখক মূল লেখাটি ইংরেজিতে লিখে পাঠিয়েছেন) |
|
|
|
|
|