|
|
|
|
|
|
ল্যাজে পা
|
ঋষিগোপাল মণ্ডল |
খাপে খাপ ঢ্যামনা সাপ। ঢোঁড়াও হতে পারে। শেক্সপিয়র বলেছেন, নামে কী আসে যায়? সুতরাং ছাড়ুন। শুরুতেই শেক্সপিয়রের উল্লেখ থাকলেও আজকের লেখাটা সেক্স বিষয়ক নয়। কী বিষয়ে লেখা বা এই লেখা আদৌ কোনও বিষয়-নির্ভর কি না, জাস্ট লেখা ফর লেখা’স সেক কি না কিংবা বিফোর রিডিং লেখাটা ভাল করে শেক করে নিতে হবে কি না, ক্রমশ প্রকাশ্য। শুরুতেই শেষটা বলে দিয়ে বাংলা মায়ের মানুষদের মজা মাটি করাটা কোনও ভদ্দরলেখকের কাজ নয়। এবং মা-মাটি-মানুষ ত্র্যহস্পর্শ পেয়েই এই লেখাকে তৃণমূল বা গ্রাসরুট লেভেলের লেখা বলে ইয়ে করারও কোনও মানে হয় না।
প্রতি প্রভাতে প্রকাশিত অগণন বাংলা-বৃত্তে আপনি প্যায়ারা পাঠক। উক্ত বৃত্তের কাঁটা কম্পাস। থুড়ি, কাঁটাবিহীন ফুলেল কম্পাস। দিক্নির্দেশক। আপনার পড়ার জোরেই বাংলা শব্দ ‘ব্রহ্ম’ হয়ে নৈঋর্তে বা ঈশানে ধাবিত হচ্ছে। যেতে যেতে বাংলা রাইটাররা রাইট অপশন মেসেজে টুক করে লিখে যাচ্ছে: শব্দ ইকুয়াল টু ‘ব্রহ্ম’। সংক্ষেপে ‘শব্দব্রহ্ম’।
প্রতি প্রভাতে ঘাগু দাই কিংবা হাতুড়ে হস্তে প্রসব হওয়া বৈধ-অবৈধ, পুষ্ট-অপুষ্ট, কচি-কাঁচা-আধদামড়া, হাফ-আখড়াই কিংবা ইনস্টিটিউশনাল (প্রাতিষ্ঠানিক) ডেলিভারি হওয়া নানা কিসিমের গ্যালন গ্যালন গিজগিজে অক্ষররাজি ও শব্দবাজির বাজারে হে পাঠক, মহামান্য পাঠক, আপনিই তো, সে আর বলতে... শিবরাত্রির সলতে। আপনি পড়েন বলেই রাতি পোহাইলেই সংবাদপত্র বিক্রেতা সাইকেলের হ্যান্ডেলে বরানগর বা ব্যান্ডেলে একখান হাজির করে বলেন...আজকের এই অ্যাক নতুন!
আপনি পড়ে পড়ে লেখকতারকা আর তারকালেখক তৈয়ার করেন। তার পর তারকা অর্থাৎ তারাগুলি নিয়ে বাতি (সবুজ), ফেসবুকে জেগে থাকে সারা রাতি। আপনার পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা নিয়েই বঙ্গীয় লেখককুল জাম্পিং ঝপাক করে এমপিথ্রি-তে সেভ করা সুমনকে (কবীর) দিয়ে গাইয়ে নেন, ‘আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু’আনা।’ |
|
লেখাটা ফেসবুকের জনপ্রিয়তম রিলেশনশিপ স্টেটাস ‘ইটস্ কমপ্লিকেটেড’-এর মতো ঠেকছে? ফালতু হ্যাজানো ছেড়ে কেসটা ক্লিয়ার করা যাক। প্রথমেই ঢোঁড়া সাপের কথা ধরুন। আরে না। সতীনাথের ঢোঁড়াইচরিতের কথা হচ্ছে না। সবেতেই সতীপনা আর সাহিত্য ফলাবেন না প্লিজ! সিম্পল, শ্লথ, নির্বিষ, হলুদ-কালো চকরাবকরা নধর চকচকে ঢোঁড়া সাপের কথাই হচ্ছে। ঢোঁড়ার হলুদ-কালো কম্বিনেশন দেখে অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়ছে। বাকিদের ট্রাফিকমামার ঢঙে হাত তুলে বলছে, দাঁড়াও পথিকবর। স্যান্ট্রো থেকে সাইকেল, মদনা থেকে মাইকেল সকলেই ক্ষণকাল তিষ্ঠিয়ে ঢোঁড়ার ইয়েলো-ব্ল্যাক কম্বি দেখে এক বার তাকে ট্রাফিক আটকানোর কালভার্ট-প্রাচীর আর এক বার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ঠাউরে চোখ কচলে নিচ্ছে। মায়াময়, মায়াবান এবং মায়াবতীরা (উঃ বা দঃ বিশেষ কোনও প্রদেশের নয়, প্রদেশ নির্বিশেষে) বলছে, এমন স্পিশিস কোথাও খুঁজে পাইনি কো আগে / ইনিই হলেন সেরার সেরা বাকি কোথায় লাগে।
আজকের লেখা ঠিক কী নিয়ে এখনও ক্লিয়ার হয়নি তো? না হওয়ারই কথা। ক্লিয়ারলি তকতকে ফন্টে, ঝকঝকে কাগজে, ফটফটে মলাটে, রংদার বিন্যাসে হররোজ যে কত্ত অযুত-নিযুত বিষয়ে কত্ত কত্ত লেখা প্রকাশ পাচ্ছে সে সবের মানে-টানে আপনার কাছে অল ক্লিয়ার তো? প্রণব বর্ধন মহাশয় তাঁর একটি লেখায় এই ধরনের অকারণ শব্দবাজিকে ‘শব্দের আমাশয় রোগ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। আপনারা রোগটি ধরতে পেরেছেন?
বঙ্গরাজ্যে পূর্ণসাক্ষর জেলার সংখ্যা বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পাঠকের সংখ্যা। প্রতি দিন, হপ্তা, পক্ষ, মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে। সঙ্গে আছে অগুনতি লিট্ল ম্যাগ। সকলের সাপ্লিমেন্ট, উত্তর সম্পাদকীয়, বিশেষ নিবন্ধ, বিশেষতর ক্রোড়পত্র, বিশেষতম সংখ্যায় প্রকাশিত এত্ত এত্ত শব্দবাণ কে খাচ্ছে বলুন তো? কেন, পাঠক! দুষ্টু লোকেরা বলছে, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না। লেখক যশোপ্রার্থী পাঠকগণ খেয়ে সামলাতে না পেরে তৎক্ষণাৎ বমি! অর্থাৎ পালটা লিখছে!
ভাল লোকরা বলছে, চার পাশে বই পড়া এবং প্রকাশের জোয়ার এসেছে এতে অত চুলকুনির কী আছে? সাক্ষরতা, বিদ্যা, বুদ্ধির বান ডেকেছে এ তো ভাল কথা। পড়াশোনা না করে মধুচক্র করলে বা পাতাখোর হলে কি বেশি ভাল হত? ডি.টি.পি নামক বিপ্লবের হাত ধরে বই প্রকাশের দারুণ ঢল নেমেছে। ‘হাত ধরে নিয়ে চলো সখা’ বলে বই এবং ডি.টি.পি একে অপরের সঙ্গে ব্যাপক ঢলাঢলিতে নেমেছে। আপনি চাইলেই ইঁদুর-উইয়েও দাঁতে কাটবে না এমন ওঁচা কাব্যগ্রন্থ, দাঁত-ভাঙানিয়া প্রবন্ধ সংকলন কিংবা পরকীয়ার পাঁচটি রগরগে আখ্যান খুবই স্বল্প খরচে (আই.এস.বি নং-এর জন্য এক্সট্রা) ছেপে দেবার প্রকাশক জাস্ট ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নগদ খসান, ছাপা মাল নিয়ে সোওওজা বাড়ি যান। ওয়ান এইট ডিমাই চার ফর্মার পাঁচশো কপি হার্ড বোর্ড বাঁধাই উইথ ফোর কালার জ্যাকেট কভারওয়ালা পুস্তক প্রকাশের জন্য দক্ষিণা কুড়ি হাজারের চেয়ে সামান্য কম। ওই পাবলিকেশনের ম্যাগাজিনে এবং ওদেরই পিরিতের কিছু সংবাদপত্রে মারকাটারি প্রিভিউ-রিভিউ ফ্রি।
কিন্তু যেন স্মরণে থাকে চারশো নব্বই কপি-ই আপনার। বইমেলায় চিনা পুতুলের ইন্ডিয়ান হকারের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শতরঞ্চি পেতে একটার সঙ্গে একটা বই ফ্রি অফারে বিক্রি করবেন, না প্রেমিকা এবং তার ছোটমাসির ননদের দামড়া ছেলেকে উপহার দেবেন সেটা আপনার ম্যাও অ্যান্ড ম্যাটার। আপনিই সামলান।
দুষ্টু লোকেরা বলছে ইন্টারনেট যে ভাবে পানু-দর্শকের চাহিদা ও জোগানের জন্য যুগপৎ দায়ী, ডি.টি.পি-ও সেই রূপ যত্ত হাবিজাবি প্রকাশনার জন্য রেসপন্সিব্ল। পুরনো লেটারপ্রেস আর ট্রেড্ল মেশিন আর সিসার অক্ষর মিলিয়ে বই ছাপানোর ঝক্কি থাকলে এত্ত আঙবাঙ লেখা ছাপা হত না। মহাদুষ্টু লোকেরা বলছে, সমস্ত স্টোন-বালি-চিপ্স ব্যবসায়ী যেমন প্রোমোটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে, সমস্ত উঠতি বাঙালি কবিই যেমন ‘দেশ’-এ কবিতা ছাপানোর স্বপ্ন দেখে, সমস্ত লিট্ল ম্যাগও বড় প্রকাশনা সংস্থা খোলার খোয়াব দেখে। তারা প্রাতিষ্ঠানিকতার পিতৃপুরুষের তেড়ে পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে, ‘আমি ছোট এবং ছোন্তুমনা সুতরাং মহান ও পবিত্র’ শীর্ষসংগীত গাইতে গাইতে এবং মহৎ মলাটের কিছু সস্তা চালাকির দ্বারা ক্রমে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। এর পর চকচকে টেরিকটনের গেরুয়া আলখাল্লা পরিহিত ট্রেনের ফেক বাউলের প্রোফাইলকে লোকায়ত চর্চার গভীর আখ্যান বলে চালানো, ফেসবুকে চাট্টি ডিজিটাল কবিতা লেখা মেগালোম্যানিয়াক লাইক-বুভুক্ষুকে ‘উড বি জয় গোস্বামী’ বলে গছানো সহ কত কাজ যে লিট্ল ম্যাগকে করতে হয়!
কথা হচ্ছে, এ সব করে, এত কাঁড়ি কাঁড়ি ছাপিয়ে বাংলা সাহিত্যের কী ঘণ্টাটা হচ্ছে? আজিকার এই লেখায় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে, শব্দের চাতুরি আর ভাষার জাগলারি দিয়ে আমি যে ট্যাঁশ রচিলাম তাতে বাংলা সাহিত্যের-লেখ্যাগারের-শব্দভাণ্ডারের কী এসে গেল? এই লেখার এবং এই লেখার বক্তব্যের আয়ু কত দিন? আগামী কাল নাকি আগামী রবিবার পর্যন্ত? কী হয় এই সব আটভাট লিখে? ছাপিয়ে?
বড় জোর বৈধ বউ আর অবৈধ প্রেমিকা ‘মারহাব্বা মারহাব্বা’ বলে শোর মচায়। ফেসবুকে গোটা পঁচিশেক ‘লাইক’ পড়ে। সে-ই বা কম কী! পুরো খাপে খাপ পঞ্চার বাপ। এই পঞ্চার বাপ কে জানতে চোখ রাখুন ঋষিগোপালের আগামী লেখায়। টিং টং। |
|
|
|
|
|