এজবাস্টন ফাইনালে জিতে এক মুকুট নয়, প্রকারান্তরে দ্বিমুকুটের উচ্চাকাঙ্ক্ষী দু’টো দলই! অ্যালিস্টার কুকের ইংল্যান্ড চায়, বারো বছর পর শনিবার অস্ট্রেলিয়ার মাঠে চিরশত্রুদের রাগবি টেস্টে হারানোর সম্মানের পাশেই থাক এটা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়! মহেন্দ্র ধোনির ভারত আবার চায়, তার সর্বকালের ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে সব চেয়ে স্মরণীয় দিনের ঠিক কাছাকাছিই এটা থাক। ২৫ জুন প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের তিরিশ বছরের জমকালো উদযাপন হোক ঠিক দু’দিন আগে ইংল্যান্ডেই বিশ্বপর্যায়ের আরও এক টুর্নামেন্ট জিতে!
বিশেষজ্ঞদের বিচারে, বিখ্যাত জুয়াড়ি সংস্থা ল্যাডব্রোকসের রেটিংয়ে, সবেতেই ভারত অবিসংবাদী সম্ভাব্য জয়ী। এমনকী ফাইনালে সব চেয়ে বেশি রান কে করতে পারেন, সেই রেটিংয়েও ভারত এগিয়ে! শিখর ধবনের ওপর খেললে যদি বাজি সফল হয়, প্রতি এক পাউন্ড খরচে জেতা যাবে নয় পাউন্ড। বাকি সব ব্যাটসম্যানের ওপর এক পাউন্ড লগ্নিতে জেতার সুযোগ থাকবে আরও অনেক বেশি পাউন্ড। মানে ধবনের রান পাওয়ার সম্ভাবনা জুয়াড়িদের কাছে বেশি।
কিন্তু ল্যাডব্রোকসে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চিতের দর নিয়েই তো খোঁজখবর নেওয়া হল না। এজবাস্টনে পুরো পঞ্চাশ ওভার নির্বিঘ্নে হওয়ার ব্যাপারে বাজির দর কী? সকাল থেকেই তো বার্মিংহ্যামে এত বৃষ্টি যে, আউটডোর প্র্যাক্টিস এক রকম বেকার হয়ে গিয়েছে। ইংল্যান্ড-ভারত সবাই ছুটছে ইন্ডোরে। বিকেলে আবার রোদ উঠে গেল। অনিশ্চয়তার তীব্রতা-কোশেন্টে ওয়ান ডে ক্রিকেটকেও হারিয়ে দিয়েছে বিলিতি আবহাওয়া!
ধোনি এমনিতেই গোটা টুর্নামেন্টে ম্যাচ প্র্যাক্টিস পেয়েছেন মাত্র ১০ বল। সুরেশ রায়না ২৬ বল। এর পরে যদি স্বাভাবিক টার্ফে অনুশীলনেরও এত কম সুযোগ পান, ফাইনালের জন্য তৈরি হবেন কী করে? আর বৃষ্টির পিঠোপিঠি এমন ঠান্ডা হাওয়া শুরু হয় যে, তার সঙ্গে উপমহাদেশীয় শরীরের টক্কর দেওয়া ঘোর সমস্যা। শনিবার হায়াত রিজেন্সির ব্রেকফাস্ট টেবলে এক সিনিয়র ক্রিকেটার বলছিলেন, “হাওয়া চললে দু’টো-তিনটে করে জার্সি পরতে হয়। তখন শরীরের ওপরটা আবার এত ভারী হয়ে যায় যে, ওয়ান ডে-র জন্য লাফানো-ঝাঁপানোটা সমস্যা হয়ে যায়। তার চেয়ে ভাল বিকল্প এটা যে, একটা জার্সিতেই নামো। একটু কাঁপবে ঠিকই। তার পর দৌড়লে-টৌড়লে গা গরম হয়ে যাবে।” |
সিমিং কন্ডিশনে স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে এখানে তাঁর অ্যাডজাস্টমেন্টের কথা বলছিলেন সুরেশ রায়না। শুনলাম, ক্লোজ-ইনে ফিল্ড করার পরিকল্পনা আগেই নিয়েছিলেন বলে রঞ্জি ট্রফি থেকেই স্লিপে দাঁড়াচ্ছেন। “কিন্তু তফাত কী জানেন? আমাদের দেশে অ্যান্টিসিপেশনেও আপনি বলটা পেয়ে যাবেন। মোটামুটি এক হাইটে আসবে। এখানে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুভ করছে। বলের শেষ অবধি না দেখলে আপনি কিছুতেই পাবেন না। প্রত্যেকটা ম্যাচে তাই নিজের মেন্টাল অ্যালার্ম সেট করতে হচ্ছে। ইনিংসের তিনশোখানা বলই মন দিয়ে দেখতে হবে,” বলছিলেন রায়না।
ধোনির ‘স্যার জাডেজা’-কে ব্রেকফাস্টে দেখলাম না। যিনি এত ঠান্ডায় বল গ্রিপ করে কী ভাবে স্পিন করাচ্ছেন, কাউন্টিগুলো চমৎকৃত হয়ে যাচ্ছে। টানা ২২২টা বল করেছেন জাডেজা গত ক’ম্যাচে, যার একটাও ওয়াইড বা নো বল নয়। এই পরিবেশে অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান! সানরাইজার্স হায়দরাবাদে যাঁর অধীনে তিনি খেলেন, সেই টম মুডি এ দিন অমিত মিশ্রকে টিম হোটেলে উৎসাহ দিয়ে গেলেন, “অমিত, কিছু করার নেই। একমাত্র কারও চোট ছাড়া এই টিমে তোমার ঢোকা সম্ভব নয়।” মনে হল, ওখানে না থাকা জাডেজা এর চেয়ে বৃহত্তর প্রশংসা আর কী পেতে পারেন!
শিখর ধবন অবশ্য ওখানেই। এই ভারতীয় দলে সব চেয়ে কৌতূহল উদ্রেক করা মানুষ। ব্রিটিশ সাংবাদিক এ দিন লিখছেন, ‘ধবন হল হাফ হেভিওয়েট বক্সার। হাফ প্রাইভেট বেলজিয়ান ডিটেকটিভ (এরকিউল পয়রো)। আর ব্যাট করে যখন বীরেন্দ্র সহবাগ!’ ফাইনালে ইংরেজদের গেমপ্ল্যানের প্রথম লক্ষ্যই হল অ্যান্ডারসনকে দিয়ে দ্রুত ধবনকে তোলো। অ্যান্ডারসন ছিলেন সচিন-সংহারক। কিন্তু নতুন জাতীয় দাবি হল, কাল ধবন ব্যাটাকে তাড়াতাড়ি হটাও।
অমিত মিশ্র বলছিলেন মুডিকে, “স্যার, ভুবনেশের বোলিং দেখছেন? কতটা করে সুইং করাচ্ছে?” মুডি ঘাড় নাড়লেন সেই ভঙ্গিতে, যে ভাবে ঘাড় নাড়ছে গোটা ইংরেজ ক্রিকেটমহল। ল্যাডব্রোকসের দরে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার ব্যাপারে যে অ্যান্ডারসনকে টক্কর দেবেন অখ্যাত ভুবনেশ, কেউ ভেবেছিল? এখনও ভারতের হোটেল-রেস্তোরাঁ-এয়ারপোর্ট-রেল স্টেশনে ভুবনেশকে অনেকেই দেখে চিনতে পারবে না।
এই ভুবনেশ-জাডেজা-ধবন-রায়না কেউ সমষ্টিগত ভাবেও তারকা নন। ব্যক্তিগত উজ্জ্বলতা তো বাদই দিলাম। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে এতটাই রাঙিয়ে দিয়েছে এঁদের তারুণ্যের স্পিরিট যে, ইংল্যান্ডে ভারতীয় গ্রীষ্মের রমরমা নিয়ে লিখতে বসে কারও তাঁর কথা মনেই পড়ছে না, যিনি আর ঠিক ছ’মাস দশ দিন বাদে পৃথিবীর প্রথম মনুষ্য হিসেবে দু’শোতম টেস্ট ম্যাচ খেলবেন! ভাবাই যায় না ব্রিটিশ মিডিয়া ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে লম্বা লম্বা আলোচনা করবে আর তাতে এক বারের জন্যও উচ্চারিত হবে না সচিন তেন্ডুলকর নামটা! মাইকেল ভন ভারতের গত ইংল্যান্ড সফরে বিদেশি মিডিয়ার এক নম্বর ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বলিউডি ছবিতে যে সব ভিলেনের নাম থাকে ‘শাকাল’ বা ‘রবার্ট’। যারা লাস্ট সিনে প্রচুর মারটার খায়। সেই রকম গরগরে রাগ ছিল ভনের ওপর ভারতীয় ক্রিকেট সম্প্রদায়ের। যার মধ্যে প্রচুর ভারতীয় সমর্থকও আছেন। ভনের অপরাধ, তিনি টুইট করেছিলেন, ‘লক্ষ্মণ নিশ্চয়ই ব্যাটে জেলি জাতীয় কোনও পদার্থ মিশিয়েছে। সে জন্য ওর ব্যাটে লেগে বল পিছনে খোঁচা হচ্ছে না।’ সুনীল গাওস্কর তখন প্রকাশ্যে লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, এখুনি মামলা করো ওর বিরুদ্ধে। ভারতীয় দল প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ছিল অ্যাসেজ জয়ী প্রাক্তন অধিনায়কের বিরুদ্ধে। মামলা হয়নি। দু’তরফে বাক্যালাপ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
সেই ভন এ দিন লিখেছেন, রবিবাসরীয় ফাইনালে শুধু নয়, ভারত ২০১৫ বিশ্বকাপেরও অন্যতম ফেভারিট। এক নিঃশ্বাসে তিনি বলছেন, “ধোনির এই টিমটা ধোনির বিশ্বকাপজয়ী ২০১১-র টিমের চেয়েও শক্তিশালী।” তাঁর বন্ধু ক্রিকেটাররাও একই রকম আপ্লুত।
পুরনো স্কোরবই ঘেঁটে-টেটে ভারতের হারের আশঙ্কা একমাত্র পাওয়া যাচ্ছে তিন রকমের শর্ত থেকে:
(১) ধোনি টস হারলেন: বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে প্রথম ব্যাট করে তাঁর টিম এ বার পড়ে গেল ডাকওয়ার্থ-লুইস নামক পৃথিবীর সবচেয়ে নৃশংস কিন্তু অনিবার্য আইনের জাঁতাকলে। যেখানে প্রথম ব্যাট করা মানে হারের ব্যবস্থা পাকা করে রাখা।
(২) আর সব ম্যাচের মতো ওপেনিং পার্টনারশিপ জমল না: মিডল অর্ডারে ম্যাচ প্র্যাক্টিস না থাকা ব্যাটাররা অতর্কিত চাপের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। গোটা টুর্নামেন্ট যে ভাবে চলেছে, তাতে চাপ নেওয়ার অভ্যেসটাতেই তো মরচে ধরে গেছে।
(৩) ডেথ ওভারগুলোয় বেশি রান ‘লিক’ করল বোলাররা: ‘লিক’ করাটা ভারত অধিনায়কের ভাষা। এমন যদি হয়, ফাইনালের চাপ নিতে গিয়ে টেনশনে স্টিফ হয়ে গেল বোলাররা। এক জন বোলারেরও তো বিশ্বপর্যায়ের ফাইনালে বল করার অভিজ্ঞতা নেই।
ভারতীয় সমর্থকেরা অবশ্য ওপরের শর্তগুলোয় বিশ্বাসী নন। মাঠ ভরিয়ে দিতে এবং ধোনির ট্রফি নেওয়া দেখতে তাঁরা আসছেন ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের নানান প্রান্ত থেকে। এমনিতেই এজবাস্টন শুকনো,
স্পিন সহায়ক পিচ বানানোর জন্য বিখ্যাত। তার ওপর শহরে এত মন্দির, গুরুদ্বার, মসজিদ। সবচেয়ে বড় যে দিকে তাকানো যায়, প্রায় সে দিকেই চিকেন তন্দুরির দোকান। ভারতীয় মিডিয়া বারবার পশ্চিমে বলিউড আর ভারতীয় ক্রিকেটের প্রসারের কথা বলে। অন্তত ইংল্যান্ডে এলে মনে হবে সাম্রাজ্য বিস্তারের আসল স্টেশন হল ভারতীয় রেস্তোরাঁ। চিকেন তন্দুরির এখানে এমনই মাহাত্ম্য যে অপেক্ষাকৃত ফর্সা টিমটাও যদি রোববার জেতে, কোনও ভারতীয় রেস্তোরাঁয় বিজয়ী নৈশভোজের আয়োজন করলে আশ্চর্য হওয়ার নেই।
মোটের ওপর বার্মিংহ্যাম ফাইনাল অনেকটাই ধোনিদের হোম ফাইনাল। তিন হপ্তা আগে এই শহরেই তো শ্রীলঙ্কাকে প্র্যাক্টিস ম্যাচে চূর্ণ করে প্রথম জ্বলেছিল তারুণ্যের রংমশাল! সে বার লর্ডসে ২৫ জুন জেতার পর পৃথিবী বলেছিল, ‘কপিল্স ডেভিল্স!’ তিরিশ বছর পরের পৃথিবী নতুন কী নামকরণ করতে পারে ‘ধোনিজ ওয়ান্ডার কিডস’?
ধোনির বিস্ময়বালকেরা বনাম আটত্রিশ বছর ট্রফি না জেতা ক্ষুধার্ত ব্রিটিশ! আবহাওয়া গড়বড় না করলে এজবাস্টনের তেইশে জুনও সর্বকালের স্মরণীয় ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে ঢুকছে! |