বিলেতের দীর্ঘতম দিবসের মতোই আজ
ধোনিদের ওপর চড়চড়ে দিনের আলো
ংরেজ ক্রিকেট লিখিয়েদের হয় মন নেই। সময় নেই। বা উদারতা নেই।
নইলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের নিরঙ্কুশ ক্রিকেটরাজ অক্ষুণ্ণ রেখে ফাইনালে ইংল্যান্ডের সামনে পড়া এমন তেল-চিটচিটে উপেক্ষা পাবে কেন?
মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে অ্যালিস্টার কুকদের চূড়ান্ত ঘাটে পৌঁছবার প্রথাপ্রকরণ যারা এত ডায়াগ্রাম ও গ্রাফিক্স সহযোগে ব্যাখ্যা করেছে, তাদের শুক্রবারের পাতার খেলার খবরগুলো এই অর্ডারে গিয়েছে:
• এস ডব্লিউ নাইনটিন, স্ট্রবেরি অ্যান্ড ক্রিম এবং অবশ্যই অ্যান্ডি মারে! মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে উইম্বলডন আর মাত্র তিন দিন দূরে।
• অস্ট্রেলিয়ায় ইংল্যান্ড লায়ন্স টিমের প্রথম টেস্ট। ইংরেজ রাগবি দলের মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ শনিবার।
• অ্যাদ্দিন আহত থাকা কেভিন পিটারসেনের কাম ব্যাক শুক্রবার কাউন্টি ম্যাচ দিয়ে।
• রিকি পন্টিংয়ের মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলে পূর্ণাঙ্গ অবসরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
• অস্ট্রেলীয় কোচ মিকি আর্থারের বিবিসি-তে দেওয়া ইন্টারভিউ, “ওয়ার্নার নিয়ে স্মার্টনেসে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড আমাদের হারিয়ে দিয়েছে।”
• চিনে বেকহ্যাম ম্যানিয়া। ফ্যানদের উত্তেজনা থামাতে গিয়ে রক্তাক্ত মহিলা পুলিশকর্মী। সবিস্তারে রিপোর্ট এবং ছবি।
বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যা। কার্ডিফে ধোনিদের লঙ্কা-জয়ের সাক্ষী।
এর পর ‘বিবিধ’ খবরটবর যে ভঙ্গিতে যায়, সে ভাবেই ভারতের শ্রীলঙ্কা সংহার পরিবেশিত হয়েছে। কেবল ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রাক্তন ক্রিকেটার ভিক মার্কস লিখেছেন, ‘ভারতকে এতটাই আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে যে বার্মিংহ্যামের আবহাওয়া কী করল না করল, তাতে ঘোড়ার ডিম আসে যায় ওদের। প্রকৃতি যা দেবে, ওরা তার ওপরই জিতবে!’
আর ব্রিটিশ মিডিয়া অবহেলা করলেও ক্রিকেট সার্কিটের মেজাজ কিন্তু গদগদ। শুক্রবার ভারতীয় দলের টিম হোটেল বার্মিংহ্যাম হায়াত-এ ঢুকে দেখলাম, ঠিক মুখটাতেই দুর্নীতি বিরোধী দফতরের গোয়েন্দা দাঁড়িয়ে। তার একটু পর লবিতে এগিয়ে গেলে, শিখর ধবনের মিনি সাইজের পাকানো গোঁফইনিও গোয়েন্দা। শুধু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আর পাঁচটা গড়পড়তা দিনের সঙ্গে তফাত--- সর্বত্র সপ্রশংস আলোচিত হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট। লবিতে আইসিসি-র দু’টো কাউন্টার। টিকেটিং। আর হসপিটালিটি। দু’টোতেই লোকে আলোচনা করছে নীল জার্সি থেকে ঠিকরে পড়া তারুণ্য-বিস্ফোরণ নিয়ে! বলছে, এটা যথার্থ ইন্ডিয়ান সামার। আইসিসি-র মিডিয়া কর্তাকে হাসতে হাসতে বলে গেলেন ওয়ারউইকশায়ারের এক সদস্য: ইংল্যান্ডের ভাগ্য ভাল যে অস্ট্রেলিয়ার মতো এখানে বেস্ট অব থ্রি ফাইনালের ব্যবস্থা নেই। রোববারটাই এক এবং অকৃত্রিম। একদিন যদি মেরে দিতে পারে। আর এক জন তখন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বলছেন, “বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে শুনছি। তা হলে তো ইংল্যান্ড যুগ্মজয়ী হওয়ার চান্স পাচ্ছে।”
বক্তা যাঁরা। কেউ বিখ্যাত শ্রেণিভুক্ত নন। ক্রিকেটমহলের পরিচিত মুখ। তবে তাঁদের মুখে যেন জনমানসের চিন্তাভঙ্গিটাই বার হয়ে আসছেইংল্যান্ড জিতলে একমাত্র কপালের জোরে জিতবে।
ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন অধিনায়ক আনা উচিত বলে যিনি ০-৮ বিপর্যয়ের পর অকুতোভয়ে পালাবদলের ডাক দিয়েছিলেন সেই মোহিন্দর অমরনাথ এ দিন মুম্বই থেকে বিকেলে ফোনে ধোনিদের খুব প্রশংসা করলেন। “আমি খেলা প্রায় দেখছি না বললেই হয়। বলা যায় কাগজেই পড়ছি। কিন্তু যা বিক্রম দেখাচ্ছে, ফাইনালটা জিতবে মনে হয়। জেতা তো উচিত,” বললেন মোহিন্দর। মোহিন্দরের সময়সাময়িক এক প্লেয়ার, যুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ বাঁ হাতি স্পিনার তিনিও নাকি উচ্ছ্বসিত ধোনিদের ক্রিকেটে! ডেরেক আন্ডারউডকে সরাসরি ধরা গেল না। শুনলাম বন্ধুমহলে তিনি বলেছেন, ইংল্যান্ডের পরিবেশে এই ভাবে উপমহাদেশীয় টিম মানিয়ে খেলছে, ভাবাই যায় না! বিশেষ করে আমরা যারা ভারতকে অতীতে হড়কাতে দেখেছি, তাদের পক্ষে আরওই অচিন্তনীয়।
স্পট ফিক্সিং অধ্যুষিত টিম মানসিক ভাবে নিজেদের গোছাতে পারবে, কেউ ভাবেইনি টুর্নামেন্টের আগে। টেকনিক্যালিও তো সাফল্যের রাস্তায় কাচের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে থাকা! কাচের টুকরো কম বললাম, তিনটে এমন লেভেল ক্রসিং যার কোথাও না কোথাও টিমের গতি আটকে যাওয়ার কথা। শুক্রবার বিকেলে টিম বার্মিংহ্যামের হোটেলে চেক ইন করার সময় ভারত অধিনায়কের মুখোমুখি হয়ে দেখা গেল, ফাইনালে উঠেও দেশজ মিডিয়ার প্রতি তাঁর অভিমান কাটেনি। আজ থেকে দশ বছর বা হয়তো দশ মাস পরেই তিনি বুঝবেন, তাঁর টিম সম্পর্কে আশা পোষণের সত্যিই কোনও বিজ্ঞানসম্মত কারণ ছিল না টুর্নামেন্টে।
১) কঠিনতম সিমিং কন্ডিশন: তা-ও তো তখন কেউ জানত না বিলেতে গত চল্লিশ বছরের সবচেয়ে হাড়কাঁপানো বসন্ত অতিথিদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। জানলে ভারতকে আরও হিসেবের মধ্যে রাখত না। অক্সফোর্ডে যখন শুক্রবার সন্ধেবেলা চড়চড়ে গরম, তখন দেড় ঘণ্টা দূরের বার্মিংহ্যামে হালকা বৃষ্টি আর ঠান্ডা। সব ক’টা ম্যাচেই এমন ঠান্ডা থাকছে যে স্পিনাররা ঠিক করে বল গ্রিপ করতে পারছে না। আর কে না জানে লজঝড়ে এই বোলিং লাইন আপে ভারতীয় স্পিনই যা কিছু ভরসা-টরসা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছিল।
২) ওয়ান ডে-র নতুন নিয়মে ২৫ ওভারের পর বল বদল: তার মানে বল পুরনো হয়ে রিভার্স করার বিশেষ সুযোগ নেই। উল্টে বল নতুন থেকে পঁচিশ ওভারের পর থেকে ফের বেশি সিম আর সুইং করে সমস্যায় ফেলার কথা।
৩) নতুন নিয়মে সার্কলের ভেতর সব সময় পাঁচ জনকে রাখতে হবে: এমনিতেই টিম ইন্ডিয়ার সার্কলের ভেতর ফিল্ড করার লোক কম। তার ওপর চার জনের জায়গায় পাঁচ জনকে রাখতে গেলে তো আরওই নাকের জলে চোখের জলে হয়ে যাওয়ার কথা।
ধোনির ভারত দিগগ্জদের আরও চমৎকৃত করে দিয়েছে তার কারণ, ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যাকে তারা টেমসে নিক্ষেপ করতে সফল। ধোনি যেমন বলেন, “এমসিসি কপিবুক আবার কী? যে যে ভাবে রান করে সেটাই তার নিজের কপিবুক।” সে ভাবেই যেন আপন মডেলে টিমকে নিয়ে তুললেন ফাইনালে।
শুক্রবারের দুপুর। বার্মিংহ্যামের হোটেলে চেক ইন করছেন শিখর ধবন।
কপিবুক একেবারে নেই বললে ভুল হবে। নতুন ফিল্ডিং নিয়মের সঙ্গে এমন দক্ষ ভাবে খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয়েছে, তার একটাই রেসিপি একসঙ্গে অনেকগুলো ভাল ফিল্ডার। বিলেতে যেমন স্মোকাররা অহর্নিশি আক্ষেপ করে একটা সিগারেটের প্যাকেটের দাম সাড়ে আটশো টাকা, বাড়িতে রান্নার মেয়ে প্রতি ঘণ্টায় ন’শো টাকা, ঠিক তেমনই ভারত অধিনায়করা ঐতিহাসিক ভাবে আক্ষেপ করেছেন, ওয়ান ডে টিমে একসঙ্গে সাত-আট জন ভাল ফিল্ডার নেই। ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিজয়ী সৌরভের টিমে কিছু দিনের জন্য ফিল্ডিং-উৎকর্ষ তৈরি হয়েছিল। দ্রুতই সেটা মিলিয়ে যায়।
টিম ধোনিতে কিন্তু একঝাঁক ভাল ফিল্ডার। কার্তিক, কোহলি, রোহিত, জাডেজা, ধবন, অশ্বিন এবং অবশ্যই রায়না। সোলকার-আজহারের পর ভারতের তৃতীয় শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ড ফিল্ডার রায়না। কার্ডিফে সেকেন্ড স্লিপে তাঁর নেওয়া তিনটে ক্যাচ বাদ দিলে অমন চোকার্স শ্রীলঙ্কাকেও অসমসাহসী মনে হতে পারত। রায়নাকে ভেতরে, ক্লোজ ক্যাচিংয়ে ঢোকাতে পেরেছেন ধোনি। কারণ সার্কলের ভেতর সিঙ্গলস বাঁচানোর আরও লোক এসে গিয়েছে টিমে। যারা দ্রুত ছুটতে পারে। এক টিপে চল্লিশ গজ থ্রো করতে পারে।
শিখর ধবন ৩৩২ রান-সহ টুর্নামেন্টের মগডালে বিচরণকারী ব্যাটসম্যান। এ দিন টিম হোটেলে ঢুকে তিনি ব্যাটটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ভুল করে কেউ লাগেজে দিয়ে দিয়েছিল। তা নিয়ে যা উর্ধ্বশ্বাস পরিস্থিতি তৈরি হল, তা থেকেই টুর্নামেন্টের ধবন-মহিমা বোঝা সম্ভব। ক’মাস আগে আবির্ভাবের ঝোড়ো টেস্ট সেঞ্চুরিটা যখন তিনি মোহালিতে করেন, লেখা হয়েছিল ব্যাটিংয়ের ধরণটা বিধ্বংসী শুধু নয়। এক-একটা স্ট্রোক তামিল ছবির সেই সংলাপের মতো, যেখানে হিরো ভিলেনকে বলছে, এত জোরে তোকে মারব যে গুগল সার্চ অবধি খুঁজে পাবে না। সেই ধবন সম্পর্কেও ভাবা হয়েছিল বল ব্যাটে আসার ভারতীয় সারফেসে তিনি যত স্বচ্ছন্দ, ততটাই অসুবিধেয় পড়বেন যেখানে বল ব্যাটে না এসে ক্রমাগত বাঁক নেয় আর দিক পরিবর্তন করে। অথচ ধবন এমন ব্যাটিং করে চলেছেন যে ইংল্যান্ড ক্রিকেটমহল রীতিমতো ছাপার অক্ষরে অনুনয় করছে, জিমি একমাত্র তুমিই পারো ফাইনালে ওর ব্যবস্থা করতে। জিমিঅবশ্যই জিমি অ্যান্ডারসন।
প্রাকৃতিক নিয়মে আজ ২১ জুন উত্তর গোলার্ধের সবচেয়ে লম্বা দিন গেল। ইংল্যান্ডে বলা হয়, ‘সামার সলস্টিস।’ দিন এত লম্বা যে অমন মেঘে ঢাকা ঝিরঝিরে বৃষ্টির বার্মিংহ্যামেও সূর্য অস্ত গেল রাত সাড়ে ন’টায়। টিম ধোনিরও যেন টুর্নামেন্টে সবচেয়ে লম্বা দিন চলছে। সব সময় তাঁর দলের ওপর প্রশংসার চড়চড়ে আলো!
ধোনি নিজেও এক দুর্ধর্ষ মাইলস্টোনের প্রান্তে উপনীত। ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জিতেছেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। টেস্ট বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে তাঁর নেতৃত্বেই টিম পয়লা নম্বর হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াকে ৪-০ সিরিজ হারিয়েছেন। আইপিএল জিতেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন। এ বার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও যদি হাত রাখেন, ভারতের অবিসংবাদী সফলতম অধিনায়ক হয়ে যাবেন।
তখন হয়তো বলা হবে ধোনি হলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সফলতম নেতা। মুঘলসম্রাট আকবরের মতোই সবচেয়ে কৃতী মুঘলরাজ। আর বঙ্গসন্তানকে হয়তো ধরা হবে সম্রাট বাবর হিসেবে। যিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জিতিয়ে মুঘল-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু সফলতম নন।
এখানকার মানুষ আজকের চেয়েও দেখছি তাকিয়ে রয়েছেন রোববারের দিকে। না, না, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালের জন্য মোটেও নয়। ‘সুপারমুন’ প্রত্যক্ষ করার জন্য। সেটা নাকি শনিবার অনেক রাত্তির করে শুরু। আর রোববার রাতে বিলিতি চাঁদ সবচেয়ে মোহময়ী, রূপসী চেহারায় দেখা দেবে।
সে দিন জিতলে নির্ঘাত বলা যাবে আর দিনের ক্যাটক্যাটে আলো নয়, ধোনিদের হাতে ধরা কাপ এখন পূর্ণিমার চাঁদের মতোই মহিমাময়! চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাক চ্যাম্পিয়নরা। তারুণ্যের ক্রিকেটীয় রোম্যান্স মিশে যাক প্রাকৃতিক রোম্যান্সের সঙ্গে।

ছবি: দেবাশিষ সেন

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.