দেবদেবীরা দুর্যোগে। উত্তরাখণ্ড থেকে ফ্রান্স— সর্বত্র বন্যায় বিধ্বস্ত তীর্থস্থান। কলির শেষ?
না কি, প্রকৃতি নারী বলেই রক্তমাংসের মানুষ থেকে ঈশ্বর, কারও রেহাই মিলল না?
গৌতম চক্রবর্তী |
পুরুষ নয়, প্রকৃতিই তা হলে সবচেয়ে শক্তিশালী? জুন মাসের ভয়াবহ বন্যায় হিমালয়ের কেদার, বদ্রী থেকে ফ্রান্সের লুর্দ্ শহরে মাতা মেরির মন্দির কাউকে রেহাই দিলেন না তিনি!
গত কয়েক দিন টিভি, কাগজ দেখে বারংবার চমকে উঠেছি। চার দিক ফাঁকা, শুধু কেদারনাথের মন্দিরটিই অক্ষত। কোথায় গেল দোকানপাট, ধর্মশালা? শঙ্করাচার্যের সমাধি নেই, শুধু ধ্বংসের শূন্যতা।
কেদার নিষ্প্রাণ। রামওয়াড়া নেই, গৌরীকুণ্ড অস্তিত্বহীন। মন্দাকিনী নদীর ধারে ওই গৌরীকুণ্ড ছিল শেষ বাস-স্টেশন। সেখান থেকেই ‘জয় কেদার’ হাঁক দিয়ে শুরু হত ১৪ কিমি হাঁটা। পর দিন ফিরে উষ্ণ প্রস্রবণে নেমে পড়া। হিমালয়-কন্যা গৌরী ওই উষ্ণকুণ্ডেই শিবকে পাওয়ার জন্য তপস্যা করেছিলেন। সেই মিথিকাল তপস্যাস্থল আজ অঝোর বৃষ্টি আর আচমকা জলোচ্ছ্বাসে চুরমার।
ঘোর কলিতে, জুন মাসের ভয়াবহ বন্যায় দুনিয়ার কোনও দেবীই নিস্তার পাননি। কেদারে দুর্যোগের সময়েই অন্য প্রান্তে ফ্রান্সের লুর্দ্ শহর থেকে পুণ্যার্থীদের উদ্ধার করে আনতে হয়েছে। পিরেনিজ পর্বতের নীচে, সেখানে মাতা মেরি এক ফরাসি কন্যাকে দেখা দিয়েছিলেন। এটাই সেই তীর্থযাত্রার সময়। কিন্তু প্রবল বর্ষা আর ফ্ল্যাশ ফ্লাডে রাস্তা বন্ধ। খবর, আগামী সপ্তাহে ওই পুণ্যস্থান খুলতে পারে। গৌরীকুণ্ড, কেদার এখনও তিন বছরের ধাক্কা।
লুর্দ্-এ রাস্তা বদলায়নি, কিন্তু কেদারের পথে বদল ঘটে যেত ফি-বছর। মনে পড়ে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে পায়ে-চলা রাস্তা ছিল সরু, মাঝে মাঝেই ঘোড়াদের সসম্ভ্রম রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের খাঁজে সরে দাঁড়াতে হত। ফেরার পথে সন্ধ্যা এলে টর্চ জ্বালিয়ে উতরাই পথ। রামওয়াড়া, গরুড় চটি তখন ছোট্ট জনপদ। গোটা তিনেক চায়ের দোকান ছাড়া কিছু নেই। পাঁচ বছর আগে দেখি, পাথরে বাঁধানো রাস্তা। |
অন্ধকার হলেও আর টর্চ বের করতে হয় না, দু’পাশে ল্যাম্পপোস্ট। রামওয়াড়ায় সুসজ্জিত রিসর্ট। কেদার মন্দিরের অদূরে হেলিপ্যাড। যাত্রীরা কপ্টারে এসে পুজো দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। খারাপ লেগেছিল, অস্বীকার করব না। কিন্তু এ ভাবে সব, সব শেষ হয়ে যেতে হয়?
কোথায় নেই শেষের চিহ্ন! জোশীমঠের কাছে ভুইন্ডার গ্রামও ধবংসস্তূপ, কোনও ক্রমে যাত্রীদের নামিয়ে আনছেন জওয়ানরা। ভুইন্ডার শেষ মানে হেমকুণ্ড, ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স’-এর রাস্তাও নিশ্চিহ্ন। তুমুল বৃষ্টি, ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড’ আর ধসের কবলে অনেকে বদ্রীনারায়ণে আটকে।
রুদ্রপ্রয়াগ থেকে অলকানন্দার স্রোত ধরে কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ হয়ে সরাসরি বদ্রী অবধি বাসরাস্তা ১৯৬৪ সালে। পাশাপাশি কেদারের রাস্তাও তৈরি হচ্ছিল। তখন বাস আসত গুপ্তকাশী অবধি। সেখান থেকে হেঁটে ফাটা চটি, মৈখন্ডা, রামপুর, গৌরীকুণ্ড। গৌরীকুণ্ড তখন এত জমজমাট নয়। যাত্রীরা ভোরে রামপুর থেকে বেরিয়ে, গৌরীকুণ্ড পেরিয়ে রামওয়াড়ায় রাতের আশ্রয় নিতেন। মাঝরাস্তায় শোনপ্রয়াগের পুল পেরোনোর পর আসত মুণ্ডকাটা গণেশের মন্দির। গৌরীকুণ্ড অবধি বাসরাস্তা পৌঁছল, গণেশ হলেন অবহেলিত। কুমারী কন্যা গৌরীর তপস্যাস্থল হয়ে উঠল কেদারযাত্রার বেসক্যাম্প এবং নতুন তীর্থ।
লুর্দ্ও বেশি দিনের নয়। ১৮৫৮ সাল থেকে সেখানে খ্রিস্টানরা যেতে শুরু করেন। তার আগের বছরেই মাতা মেরি নাকি দর্শন দিয়েছিলেন। গৌরীকুণ্ডের হিমালয়কন্যা কাউকে দর্শন দেননি। কিন্তু ত্রিযুগীনারায়ণে তাঁর বিবাহমন্দির আজও অক্ষত। সেখানে নারায়ণের উপস্থিতিতে হরগৌরীর বিয়ে। বাসরাস্তা হরিদ্বার থেকে সটান গৌরীকুণ্ডে আসার পর তার গুরুত্ব হারিয়ে গেল। এক বার সেখানে গিয়েছিলাম। গর্ভগৃহে সারা ক্ষণ ধুনি জ্বলে, কোনও দম্পতি একত্র গেলেই পুরোহিত মালাবদল করিয়ে দেন। লুর্দ্ মাতৃমন্দির। গৌরীকুণ্ড, ত্রিযুগীনারায়ণ বিবাহ-উৎসুক প্রণয়িনীর। বন্যা কাউকেই ছেড়ে কথা বলেনি।
দুই দেবীই যুদ্ধ দেখেছেন। লুর্দ্ দেখেছে সম্রাট শার্লেমান, ইংরেজ-ফরাসি সংগ্রাম। আর চিন-ভারত যুদ্ধের পর, ১৯৬৪ সালেই কেদার-বদ্রীর বাসরাস্তা তৈরি।
ষাটের দশকে তৈরি রাস্তাটার গুরুত্ব অন্যত্র। পরে হনুমানচটি, গঙ্গোত্রী অবধি পৌঁছে গেল রাস্তা, শুরু হল গাড়িতে কেদার-বদ্রী-গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রীর ‘চার ধাম দর্শন’। শাস্ত্রমতে, চার ধাম অন্য। উত্তরে বদ্রী, দক্ষিণে রামেশ্বর, পূর্বে পুরী আর পশ্চিমে দ্বারকা। পুণ্যার্থীরা আগে বদ্রীতে অলকানন্দার জল নিয়ে রামেশ্বর শিবের মাথায় ঢেলে আসতেন।
লুর্দ্ তীর্থস্থান। কিন্তু থাকবন্দি ভারতীয় সমাজে তীর্থ আর ধামে তফাত অনেক। তীর্থ মানে, জলের ঘাট। তীর্থযাত্রা: খাঁড়ি বেয়ে পার্থিব জীবন থেকে আধ্যাত্মিক জীবনে পৌঁছানো। ধামের অবস্থান আরও উচ্চে, সেটিই দেবতার আবাস। যজ্ঞবেদী যেমন অগ্নির ধাম, সেখানেই তাঁর তেজঃপুঞ্জ প্রকাশিত হয়। হিমালয়ের বুকে ষাটের দশকে তৈরি পিচরাস্তাটা বদলে দেয় শাস্ত্রোক্ত চার ধামের আইডিয়া। কেদার আগে ছিল তীর্থ, রাস্তা তৈরির পর ধাম।
এই থাকবন্দি সমাজই সান্ত্বনা। লুর্দ্-এর বন্যায় তিন পুণ্যার্থী ভেসে গিয়েছেন, গৌরীকুণ্ডের ক্ষতি আরও ভয়ঙ্কর। সাততলা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। কিন্তু কেদারনাথের জ্যোতির্লিঙ্গে প্রণাম করে মনে মনে ওই যে একটা কথা বলতাম! নমঃ শিবায় শান্তায় কারণাত্রয় হেতবে। শিবই সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এই তিনের কারণ। দেবাদিদেব যদি নিজেকে অক্ষত রেখে স্ত্রীর তপস্যাস্থলের লয় ঘটিয়ে থাকেন, ঘটিয়েছেন। স্বামীর ইচ্ছাই সব! লুর্দ্-এ মেরি দর্শন দিয়েছিলেন এক কৃষক-কন্যাকে। উত্তরাখণ্ডের দেবভূমিতে কিন্তু এক বৈদান্তিক সন্ন্যাসী আজও অমর। আদি শঙ্করাচার্য। কেদার-বদ্রী নাম দুটি একসঙ্গে উচ্চারিত হয় ঠিকই। কিন্তু তফাত রয়েছে। কেদারে শিবলিঙ্গ, বদ্রীতে ধ্যানস্থ বিষ্ণুমূর্তি। মিথ: শঙ্করাচার্য অলকানন্দা থেকে মূর্তিটি উদ্ধার করেন, কেদারে তাঁর সমাধি। হিমালয়েই শৈব-বৈষ্ণবদের বিভেদ ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বৈদান্তিক সন্ন্যাসী? আজও বদ্রীতে নর আর নারায়ণ পর্বতের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে বরফঢাকা ‘নীলকণ্ঠ’।
সন্ন্যাসী জীবদ্দশাতেই স্থির করেছিলেন, তাঁর পর কোন শিষ্য কোন পীঠের দায়িত্ব নেবেন। পরীক্ষা হল। অথর্ববেদে তোটকাচার্যকে কেউ হারাতে পারল না। তাঁকে করা হল জোশীমঠের আচার্য। অথর্ববেদ কেন? সন্ন্যাসী কি চেয়েছিলেন, দর্শনের পাশাপাশি হিমালয়ের ওষধি নিয়েও ভাবতে হবে?
মন্দিরের অল্প দূরে, উর্বশীপীঠ। আজও সেখানে পুণ্যার্থীরা সংকল্প করেন, ‘নার প্রকৃতিদেবী সম্ভবত মেয়ে হয়েও মেয়েদের শত্রু! |