সিলিং পাখার একটি উপযোগিতা বাতাস প্রদান, আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপযোগিতা আত্মহত্যায় সহায়তা। যুগ যুগ ধরিয়া শত শত মনুষ্য আত্মহত্যার জন্য কেবল এক গাছি রজ্জু সংগ্রহ করায় মন দিয়াছেন, কী হইতে ঝুলিবেন তাহা লইয়া কণা মাত্র উদ্বিগ্ন হন নাই, সিলিং-পাখা তাঁহাদের প্রকল্পে ত্রিহস্ত বরাভয় দিয়া বিরাজ করিয়াছে। পাশ্চাত্যে অধিকাংশ মানুষ আত্মহনন করেন মণিবন্ধের শিরা কাটিয়া বা ঘুমের বড়ি গিলিয়া কিংবা বহুতল-বাতায়ন হইতে লম্ফ দিয়া। তাহার প্রধান কারণ, ওই সকল অঞ্চলে ঘর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সিলিং পাখার বালাই নাই। অথচ, পাখার সহিত গ্রন্থিবদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর মধ্যে, বাল্যবন্ধুর হাত ধরিয়া চিরনির্বাণ লইবার কোমল দ্যোতনা রহিয়াছে। যে বান্ধব বৎসর বৎসর ধরিয়া বাতাস দিয়া স্বেদাক্ত দেহ জুড়াইয়াছিল, ক্লান্ত কপোল মুছিয়া উজ্জীবিত করিয়াছিল, তাহারই প্রত্যক্ষ সহায়তায় শীতলতার দেশে যাত্রার মধ্যে গ্রিক ট্র্যাজেডির মহত্ত্ব ও ক্রন্দন বর্তমান। তদুপরি, বাথটাব বা শয্যায় শুইয়া মরিলে, মৃতদেহ আবিষ্কৃত হইতে সময় লাগিয়া যায়। ফলে, শোকও বিলম্বে শুরু হয়। তাহা ছাড়া, ওই ভঙ্গিমার মধ্যে একটি পরাজয় রহিয়াছে, বিমর্ষ ও নির্জীব ‘মানিয়া লওয়া’ রহিয়াছে। কিন্তু ঘরের মাঝমধ্যিখানে পাখা হইতে ঝুলিয়া থাকিলে তাহা প্রথমেই চোখে পড়িতে বাধ্য এবং দর্শকটি চরম আঁতকাইয়া উঠিয়া এই প্রকট বীভৎসার একটি সপাট ধাক্কা খাইতে বাধ্য। এই ঘাড় বাঁকাইয়া জিভ বাহির করিয়া শেষ যাত্রায় বিশ্বাসঘাতক ইহজীবনকে প্রাণপণ একটি ভেংচি কাটিয়া যাইবার মধ্যে তীব্র প্রতিবাদও জ্বলজ্বল করিতেছে। এই বার মধ্য প্রদেশের এক জন ডাক্তার এমন সিলিং পাখা আবিষ্কার করিলেন, যাহা ব্যবহার করিয়া গলায় দড়ি দেওয়া অসম্ভব।
ডাক্তারবাবু সপ্তাহখানেক ভাবিয়া যে আশ্চর্য পাখা আবিষ্কার করিয়াছেন, তাহার গোড়ায় কিছু স্প্রিং রহিয়াছে। পঁচিশ গ্রাম-এর অধিক ওজনের কেহ পাখা হইতে ঝুলিলেই, স্প্রিংগুলি কাজ করিবে, অর্থাৎ পাখাটি প্রলম্বিত হইয়া ধীরে মানুষটিকে মাটিতে নামাইয়া দিবে এবং তাহার ঘাড় ভাঙিবে না। পাখার দাম হইবে মাত্র ৪৫০ টাকা। হেস্টেলে বা যে কোনও কিশোর বা কিশোরীর ঘরে এই পাখা লাগাইলে আত্মহত্যার অন্তত একটি পথ বন্ধ করা যাইবে। কে বলিতে পারে, ঘরে পাখা নাই বলিয়া করিব-করিব করিয়া কর্মটি শেষ অবধি করাই হইয়া উঠিবে না। আইআইটি-তে স্বহত্যার ক্রমবর্ধমান হার দেখিয়া একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি ছাত্রছাত্রীর ঘরের সিলিং পাখাগুলি খুলিয়া পেডেস্টাল পাখা লাগাইবার পরামর্শ দিয়াছিলেন। ফলে এই পাখার বাস্তব প্রয়োজন রহিয়াছে। কেবল, কয়েকটি সমস্যা গজাইয়াছে। কোনও আত্মহত্যাকামী মানুষ এই পাখা কিনিয়া লইয়া গেলে বেমালুম ঠকিবেন। তাহার পর তিনি গ্রাহক ফোরামে মামলা করিতে পারিবেন কি? আর, পঁচিশ গ্রামের কম ওজন বিশিষ্ট মানুষ পাখায় ঝুলিয়া আত্মহত্যা করিবেন না, এ কথা আবিষ্কর্তা ভাবিলেন কী করিয়া? শিশু বা অতি ক্ষীণতনু ব্যক্তি বা কোনও বামন কি আত্মহত্যা-চিন্তার বৃত্তের বাহিরে? হ্যাঁ, তাঁহারা পাখার নাগাল পাইতে ফ্যাসাদে পড়িবেন ঠিকই, কিন্তু টেবিল চেয়ার জড়ো করিয়া তাহা নিতান্ত পারিবেন না, নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। সর্বোপরি, যে মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত লইয়াছে, তাহার একটি পথ বন্ধ করিলে তাহার সিদ্ধান্তটিই রদ করা যাইবে, এমন ভাবনার মূলে রহিয়াছে এই চিন্তা: আত্মহত্যা তাৎক্ষণিক আবেগতাড়িত। সুপরিকল্পিত নহে। বহু দিন হইতে প্রায় দর্শনের স্তরে হতাশা লইয়া যাইয়া আত্মহনন ভাঁজিতেছেন যাঁহারা, তাঁহারা এই ধারণায় অতিশয় আহত হইতে পারেন। |