উত্তরাখণ্ডে সারা দিনে উদ্ধার দশ হাজার |
উদ্ধারকাজ শেষের আগেই ফের বর্ষার আতঙ্ক |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
হাড়-গোড় ঠেলে বেরিয়ে আসা পাহাড়গুলোর খাঁজে কত জন আটকে আছেন, ছবিটা স্পষ্ট হয়নি এখনও। তার মধ্যেই ফের অশনি-সংকেত। আবারও ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে। মৌসম ভবন জানিয়েছে, রবিবারই বৃষ্টি নামবে হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের কিছু অংশে। আবহবিদদের আশঙ্কা, সোমবার বৃষ্টির বেগ যেমন বাড়বে তেমনই তা আরও ছড়িয়ে পড়বে চারপাশের অঞ্চলে।
হাতে সময় বলতে একটা গোটা দিনও আর নেই। তার আগে যত বেশি মানুষকে নীচে নামিয়ে আনা যায়, প্রাণপণে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। সব মিলিয়ে মোট ৬১টি হেলিকপ্টার আজ সারা দিন চক্কর কেটেছে বন্যাবিধ্বস্ত উত্তরাখণ্ডে। সময় কম থাকায় উদ্ধারকাজ বাদ পড়ছে না রাতেও। আজ সারা দিন ধরে অন্তত ১০০০০ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। |
|
চাপা পড়ে গিয়েছে গৌরীকুণ্ডের এই মন্দিরটি। আরও বৃষ্টি হলে হয়তো ঢেকে যাবে চূড়াটুকুও। ছবি: পিটিআই |
উদ্ধারকাজে গতি বাড়াতে আজ থেকে বায়ুসেনার বিশেষ বিমান কাজ শুরু করেছে ওই অঞ্চলে। বিশ্বের সব চেয়ে বড় হেলিকপ্টার এমআই-২৬ এত দিন ব্যবহার করা হত সেনা বা জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজে। আজ চপারের জ্বালানি সরবরাহের কাজে নামানো হয়েছে তাকে। এ দিকে সকালে খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেই ধারাসু হেলিপ্যাড গ্রাউন্ডে নামে সি-১৩০জে নামে আরও একটা বিশেষ বিমান। সরু রানওয়েতেও অনায়াসেই ওঠা নামা করতে পারে তা। বন্যায় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাওয়া অঞ্চলে মানুষজনকে উদ্ধার করতে এই বিমান বিশেষ কাজে আসবে বলেই মনে করছে সেনাবাহিনী।
রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত মোট ৭৩০০০ তীর্থযাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন জায়গায় আটকে রয়েছেন অন্তত ৪০০০০ মানুষ। সরকারি হিসেব মতে, মৃতের সংখ্যা গত কালই সাড়ে পাঁচশো ছাড়িয়েছিল। কেদারনাথ মন্দিরের চাতাল ও আশপাশে কত দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তার হিসাব নিতে আট সদস্যের এক দলকে আজ সেখানে পাঠানো হয়। মন্দির চত্বর থেকে আজও ১২৩টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। মৃতের সংখ্যা অচিরেই হাজার ছোঁবে বলে আশঙ্কা প্রশাসনের। |
|
গৌরীকুণ্ডের কাছে ধসে ভেঙে পড়া রাস্তার উপর ঝুলে রয়েছে বাড়িগুলি। ছবি: পিটিআই |
এ দিকে গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথ যাওয়ার রাস্তায় আটকে পড়া হাজার জন পর্যটকের খোঁজ মিলেছে আজ। তাঁদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা চালাচ্ছেন সেনারা। কেদারনাথের পথে রামবারা ও জঙ্গলচটিতে আটকে রয়েছেন হাজারেরও বেশি পুণ্যার্থী। তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জনকে আজ উদ্ধার করে গৌচর ত্রাণ শিবিরে নিয়ে আসা হয়েছে। ধারাসু থেকে খোঁজ মিলেছে আরও ১৭ জন বিদেশি পর্যটকের। উত্তরাখণ্ডের সরকারি মুখপাত্র মলকেশ্বর কলকুরি জানিয়েছেন, এ দিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বদ্রীনাথ থেকে ২৫০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে এখনও আটকে রয়েছেন ৫০০০ জন। এ দিকে গঙ্গোত্রীতে আটকে থাকা সবাইকে আজ উদ্ধার করেছেন সেনারা। উদ্ধার হওয়া মানুষজন যাতে হরিদ্বার বা দেরাদুনে নির্বিঘ্নে নেমে আসতে পারেন, বিনা ভাড়ায় তাঁদের সেখানে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণা।
তবে উদ্ধারকাজ পুরোদমে চললেও চপারে ওঠার সুযোগ যে সহজে আসছে না, ফিরে আসা সকলেই কবুল করেছেন তা। দীর্ঘ লাইনে হেলিকপ্টারে ওঠার প্রতীক্ষা সারা দিন ধরে। ভাগ্যবান কয়েক জন সুযোগ পাচ্ছেন আর শিকে ছিঁড়ছে না অধিকাংশেরই। এক সপ্তাহ আগে যে ঝড় বয়ে গিয়েছে তাঁদের উপর দিয়ে, হাজার চেষ্টা করেও ভুলতে পারছেন না তা। “গৌরীকুণ্ডে সাত দিন ধরে আটকে আছি,” জানালেন এক মহিলা। “দলে মোট তেরো জন ছিলাম। এখন আছি মোটে তিন জন। বাকি দশ জনের কোনও খবর পাচ্ছি না। তার উপর খাবার শেষ। পানীয় জলটুকু পর্যন্ত নেই। এর মধ্যেও বিদেশিদেরই বেছে বেছে নামিয়ে আনা হচ্ছে। যত উপেক্ষার শিকার দেশের মানুষ।” ডুকরে উঠলেন ওই মহিলা। একই ছবি বদ্রীনাথেও। প্রায় সাত দিন ধরে যুদ্ধ করতে করতে কোনও মতে টিঁকে থাকা মানুষগুলো আজ ধৈর্যের শেষ সীমায়। “সরকার আমাদের কথা শুনছেই না। না খেতে পেয়ে মরে যাওয়ার পর কি আমাদের উদ্ধার করতে আসবে!” ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বদ্রীনাথে আটকে থাকা এক মহিলা। |
অলকানন্দার ভাঙন ধরা তীরে
নেমেছে হেলিকপ্টার। তাতে ঠাঁই
পেতে লম্বা লাইন। ছবি: রয়টার্স |
জলের তোড়ে ভেঙে পড়েছে অস্থায়ী সেতু।
উদ্ধারের কাজ চালানোর নতুন
উপায়ের সন্ধানে
জওয়ানরা। শনিবার গোবিন্দঘাটে। ছবি: পিটিআই |
|
মনে এক রাশ আশঙ্কা আর ছোটাছুটির মধ্যে দিন কাটছে দেরাদুনেরও। প্রিয়জনের খোঁজ নিতে উত্তরাখণ্ডের রাজধানীতে জড়ো হয়েছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পরিজনেরা। ছবি বুকে আঁকড়ে তাঁরা এক বার দৌড়চ্ছেন হাসপাতাল। সেখান থেকে আবার ছুটছেন কোনও ত্রাণ শিবিরে। “এত বড় বিপর্যয়ের পরও সরকারের বিন্দুমাত্র কোনও হেলদোল নেই, কেউ এগিয়ে আসছে না সাহায্য করতে,” রাগ চাপতে পারছেন না তাঁরা। গৌরীকুণ্ড থেকে উদ্ধার হয়েছেন এক যুবক। তিনি চপারে উঠতে পারলেও জায়গা হয়নি তাঁর আত্মীয়দের। জানালেন, “গৌরীকুণ্ডে এখনও কম করে আড়াই হাজার মানুষ রয়েছেন। একটা কপ্টারে তো বড়জোর ১০-১৫ জন উঠতে পারে, এতগুলো মানুষ উদ্ধার হবে কবে” প্রশ্ন তাঁর।
ত্রাণ ঠিক মতো পৌঁছচ্ছে কি না তা সরেজমিনে দেখতে আজ দেরাদুনে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে। রাজ্য প্রশাসনের কর্তা ও উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণার সঙ্গে বৈঠকও করেন তিনি। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিন দিনের মধ্যে উদ্ধার কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সেনাবাহিনী চেষ্টা করলেও কোথাও একটা সমন্বয়ের অভাব থেকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাই বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের বিশেষজ্ঞ ভি কে দুগ্গলকে এলাকায় থেকে গোটা বিষয়টি তদারকি করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। আজ আকাশ পথে বন্যাবিধ্বস্ত রুদ্রপ্রয়াগ, উত্তরকাশী, চামোলি ঘুরে দেখেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। |
|