|
|
|
|
রাজনীতিতেও ঘোলা গঙ্গার জল |
দুর্যোগ সামাল দিতে নিধিরাম জাতীয় কর্তৃপক্ষ |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
এ বার ঢেলে সাজার পালা! কিংবা আরও সতর্ক ভাবে বললে, সরকার যে তা নিয়ে ভাবছে সে কথা জানিয়ে দেশকে আশ্বস্ত করার পালা।
প্রসঙ্গ, দেশের বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থা। তাতে যে কোথাও একটা বড় রকমের গলদ রয়ে গিয়েছে, উত্তরাখণ্ডে তা নগ্ন ভাবে দেখিয়ে দিয়েছে রুদ্র প্রকৃতি। এ বার সেই ব্যবস্থার খামতি দূর করার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে সরকার।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশের শীর্ষ যে সংস্থাটি গড়ে রাখা আছে, সেটা নেহাতই একটা মাথাভারী ব্যবস্থা, সে ব্যাপারে টনক নড়েছে সরকারের এবং বিরোধী পক্ষেরও। উত্তরাখণ্ডে এত মানুষের প্রাণহানি, চরম দুর্গতি, প্রকৃতির তাণ্ডবলীলার পর দেখা যাচ্ছে, তারাও সরকারের বিচ্যুতি ও খামতিগুলি তুলে ধরতে সরব। কেন্দ্র ও ওই রাজ্যটিতে এখন একই দলের সরকার। তা-ও বাদ যাচ্ছে না ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজে ব্যর্থতা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য চাপান-উতোর। দায় এড়াতে পারছে না ইউপিএ সরকার। কারণ, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ বা এনএমডিএ-র চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। |
|
চলছে উদ্ধারকাজ। ছবি: রয়টার্স |
সমস্যা হল, এনডিএমএ শুধু পরামর্শ দিতে পারে। পরিকল্পনা ও নীতি তৈরি করা ও সেগুলি রূপায়ণের ক্ষেত্রে শুধু সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এনডিএমএ-কে। নিজেদের তৈরি পরিকল্পনা বা নীতি আদৌ রূপায়িত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার ক্ষমতা নেই তাদের। অবস্থাটা আক্ষরিক অর্থেই নিধিরাম সর্দারের মতো। এই এনডিএমএ-র অধীনেই রয়েছে জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী বা ন্যাশনাল ডিজ্যাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিআরএফ)। সেই বাহিনীতে বর্তমানে কোনও ডিরেক্টর জেনারেল নেই। ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি)-র ডিজি অজয় চাড্ডাই এনডিআরএফ-এর অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সব চেয়ে আশ্চর্যের হল, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই যুক্ত নন এই সংস্থাটির সঙ্গে। এটি পরিচালনা করেন ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ৮ জন সদস্য। সদস্যরা পান প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা। আর ভাইস-চেয়ারম্যান ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা। বিজেপি-র অভিযোগ, পেশাদার এবং বিশেষজ্ঞদের বদলে রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে সংস্থা চালানোর ফলেই সমস্যা। এনডিএমএ-র বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান এম শশীধর রেড্ডি আসলে কংগ্রেসের নেতা। সনিয়া গাঁধীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তাঁকে ওই পদে বসিয়ে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে।
উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর্যালোচনায় বসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষ কর্তারা মনে করছেন, এই ধরনের বড় মাপের দুর্যোগ মোকাবিলায় এনডিএমএ-কে আরও তৎপর করে তুলতে হলে এখনকার মাথাভারী অবস্থা শুধরে এর গঠনতন্ত্রে আমূল রদবদল প্রয়োজন। যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, “উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকারের তরফেও গাফিলতি রয়েছে। গত বছর রাজ্যকে হরিদ্বারের কাছে জমি দিতে বলা হয়েছে, যাতে সেখানে এনডিআরএফ-এর একটি ব্যাটেলিয়ন মোতায়েন রাখা যায়। বারবার বলা সত্ত্বেও রাজ্য তা করেনি। ফলে হরিদ্বারে এনডিআরএফ-এর মাত্র একটি দল মোতায়েন ছিল। সেই দলে সদস্য ছিল মাত্র ৩২ জন।” এখন এনডিআরএফ-এর ১৪টি দল উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে উত্তরাখণ্ডে। কিন্তু তাদের উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের ব্যাটেলিয়ন সদর দফতর থেকে প্রথমে সড়কপথে দেরাদুন, সেখান থেকে বায়ুসেনার বিমানে কেদারনাথ ও অন্যান্য এলাকায় পৌঁছে দিতে অনেকটাই সময় নষ্ট হয়। ফলে বিপর্যয় ঘটার পরে দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর মাঠে নামতেই দেরি হয়ে যায় অনেক। |
|
|
দড়ির সাহায্যে নদীর ওপারে আটকে থাকা মানুষজনকে উদ্ধার
করে নিয়ে আসছে সেনা। ছবি সেনাবাহিনীর সৌজন্যে। |
|
|
|
আঙুল উঠছে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকেও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের মতে, উত্তরাখণ্ডে দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা, আইটিবিপি, এনডিআরএফ ও নৌসেনার জওয়ানরা প্রশংসনীয় কাজ করলেও, প্রথম দিকে এদের মধ্যে কোনও সমন্বয়ই ছিল না। তাদের মধ্যে ঠিকঠাক সমন্বয় থাকলে উদ্ধারকাজে আনেক বেশি সাফল্য মিলত। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দেও আজ দেরাদুনে গিয়ে সমন্বয়ের অভাবের কথা কবুল করেছেন। এখন তাই এনডিএমএ-র সদস্য, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব ভি কে দুগ্গলকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনিই এনডিএমএ-তে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং উত্তরাখণ্ড, হিমাচলের মতো রাজ্যগুলির দায়িত্বে। কিন্তু সমন্বয়ের এই অভাবটুকু বুঝতেই কেন এক সপ্তাহ লাগল, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও।
একই ভাবে কেন্দ্র কেন এত দিন জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা সংস্থাটিকে নিধিরাম বানিয়ে রেখেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, এনডিএমএ-র কাজকর্ম এবং গঠনতন্ত্রে যে রদবদলের প্রয়োজন রয়েছে, তা আগেই বোঝা গিয়েছিল। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি টাস্ক ফোর্সও গড়া হয়। সেই টাস্ক ফোর্স কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছে, আইনে পরিবর্তন করে এনডিএমএ-কে আরও মেদহীন করা হোক। তার বদলে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলিকে এনডিএমএ-র সঙ্গে সংযুক্ত করা হোক। যাতে সমন্বয় বাড়ে ও দায়বদ্ধতাও সুনিশ্চিত হয়। এ বার উত্তরাখণ্ডের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে টাস্ক ফোর্সের সুপারিশগুলি দ্রুত কার্যকর করতে চাইছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সমস্যা হল, সরকারের মধ্যেই এ বিষয়ে দু’টি মত রয়েছে। একটি হল, এনডিএমএ নীতি ও পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে খুবই ভাল কাজ করছে। কাজেই নতুন কোনও বদলের প্রয়োজন নেই। অন্য মত হল, সেই নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে এনডিএমএ পুরোপুরি ব্যর্থ। |
|
উত্তরাখণ্ডে সাহায্যের জন্য চলছে অর্থসংগ্রহ। পার্ক স্ট্রিটে। —নিজস্ব চিত্র |
এই সব চিন্তা, টাস্ক ফোর্স গঠন, রিপোর্ট পেশ.... নিরন্তর এই সরকারি প্রক্রিয়ার ফাঁকেই তো বিপর্যয় নেমেছে উত্তরাখণ্ডে! এখন ভাবনা শুরু হয়েছে নতুন করে। নানা মতের জাল কাটিয়ে সরকার কত দিনে ও কী ভাবে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থাকে আরও খানিকটা তৎপর করে তুলতে পারবে, পরের কোনও বিপর্যয়ের আগে তা হয়ে উঠবে কি না, মূল চিন্তা সেটাই। |
|
|
|
|
|