|
|
|
|
ভোট পেতে মরিয়া সব দল |
কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে গ্রামের অধিকাংশ ভোটার |
বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য • ময়নাগুড়ি |
ছেলেরা কবে আসবে? দুই তরুণ সিপিএম কর্মীর প্রশ্নে ফিরে তাকালেন সরবালা রায়। মাথায় কদম ছাট পাকা চুল রোদে পুড়ে তামাটে। মুখের চামড়া জুড়ে গিলে করা কাপড়ের মতো ভাজ। পরনে সাদা কাপড়টা ছিঁড়ে ন্যাকড়ার মতো হয়েছে। গেরস্থালির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। স্বামী নেই। এক ছেলে কাজের খোঁজে সাত মাস হয়েছে ভিন রাজ্যে গিয়েছে। মেয়ের ঘরের এক নাতিকে এনে রেখেছেন বাড়িতে। দরমার বেড়া দেওয়া ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে সরবালা রাজবংশীতে বলেন, “মুই জানো না।”
ফোন নম্বর আছে? ছেলেরা জানতে চাইলেন। ষাটোর্ধ বৃদ্ধা গুরুত্ব দিলেন না। বিড়বিড় করে বললেন, “এত দিন কাহ পুছে নাই। এলা ভোট নাগিসে তো বেটাক নাগে।” দুই তরুণ কর্মী আর অপেক্ষা করলেন না একই খোঁজে চলে গেলেন অন্য বাড়িতে।
শুধু সিপিএম কর্মী নয় ময়নাগুড়ির উত্তর মাধবডাঙ্গার দ্বীপনগর এলাকায় এ ভাবে ছেলেদের খোঁজে প্রতি দলের কর্মীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একই রকম জবাব আসছে বিভিন্ন ঘর থেকে।
কিন্তু ভোট বড় বালাই। বিরক্ত হলে চলবে না। তাই মেজাজ হারাচ্ছেন না কেউ। অনেক কটু কথা হজম করার পরে কবে আসবে জানতে পারলে ভাল, না হলে ফোন নম্বর জোগাড় করে যোগাযোগ করে ভোটের আগে গ্রামে ফেরার আর্জি রাখছেন।
একই ছবি চূড়াভাণ্ডার, সাপটিবাড়ি, রামসাই, বার্নিশ, ধুপগুড়ির বারঘরিয়া, গধেয়াকুঠি, গাদং, ঝারআলতা গ্রাম, মালবাজার মহকুমার ক্রান্তি, মৌলানি, রাজাডাঙ্গা এলাকা জুড়ে। বেশির ভাগ গাঁয়ের ছেলেরা কাজের খোঁজে দিল্লি, হরিয়ানা, কেরল, জম্মু, উত্তরপ্রদেশের মতো ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। কিছু গ্রামের পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে রাজনৈতিক দলের নেতারা ভোটের প্রচারের কাজে কর্মী পাচ্ছেন না। বাঁশ বাগান ছাড়িয়ে ধরলা ঘেরা দ্বীপনগর গ্রামের ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের নেতা গৌরাঙ্গ শর্মা বলেই বসলেন, “গ্রামের অনেক ছেলে বাইরে আছে। ভোটে প্রচারের কাজে সমস্যা হচ্ছে। ওঁরা যেন অন্তত ভোট দিতে আসে সেজন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।”
কেন গৌরাঙ্গবাবুরা তৎপর হবেন না? দাস পাড়ার মতো কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে তরুণ ও যুবক খুঁজে পাওয়া যায় না। একশো পরিবারের বসবাস সেখানে। সিন্দারা জানান, ইতিমধ্যে মৎসজীবীদের ওই পাড়া থেকে ষাট জন বাইরে চলে গিয়েছে।
কেন ছেলেরা বাইরে চলে গেল? গ্রামে কাজ নেই? প্রশ্ন শুনে এলাকার তৃণমূল সমর্থক বীরেন দাসের গলা যেন ধরে এল। তিনি জানালেন কেমন করে চোখের সামনে পাল্টে গেল গ্রাম। নদীতে মাছ নেই। রুজি রোজগার বন্ধ। বংশপরম্পরায়ের পেশা ছেড়ে কয়েক মাস আশপাশের গ্রামে ঘুরে দিন মজুরি খেটেছেন মহিন দাস, ভবেন দাস, রমেন দাস, বৃন্দাবন দাসের মতো ছেলেরা। কিন্তু ঘরের অভাব মেটেনি। এক দিন ওঁরা দল বেঁধে কাজের খোঁজে পাড়ি দেয় ভিন রাজ্যে। সেই শুরু। তিনি বলেন, “গ্রামে দিন মজুরি খেটে দেড়শো টাকা মেলে। একশো দিনের কাজ সব সময় হয় না। দিল্লিতে রাজমিস্ত্রির সঙ্গে থেকে পাচ্ছে সাড়ে তিনশো টাকা। রাতে খাটলে আরও টাকা। কী হবে এখানে থেকে?” বীরেনবাবুর এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। তবে একটা উত্তর অবশ্য দিয়ে দেন ধুপগুড়ির গাদং গ্রামের শঙ্খনাথ রায়। এক সপ্তাহ হয়েছে ওই যুবক কেরালা থেকে ফিরেছেন। তিনি বলেন, “ভোটের সময় অনেকের কাছ থেকে অনেক কথাই শুনি। পরে কেউ খোঁজ রাখে না। তিন বিঘা জমি আছে। আলু করে সবই শেষ হয়েছে। কাজের জন্য কত ঘুরেছি। ঋণ চেয়েছি। কিছুই পাইনি। ৪ বছর আগে এক বন্ধুর সঙ্গে কেরলে চলে যাই। এখন ভাল আছি।” |
|
|
|
|
|