স্মরণ...
ছিল না তোপধ্বনি
হিন্দু সৎকার সমিতির শববাহী গাড়ি নয়। রাজা যাবে রাজার মতো লরিতে। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম শনিবার এ ভাবেই এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন তরুণরা। তার কিছুক্ষণ আগে ৬ ফেব্রুয়ারি রাত এগারোটা পাঁচ মিনিটে ওই হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ফেলেছেন ঋত্বিক ঘটক।
মৃত্যুর সময়েও মুক্তি পায়নি তাঁর শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো।’ ১৯৫২ সালে তৈরি প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ও ক্যানবন্দি। কয়েক বছর আগে ‘কোমল গান্ধার’ ছবির সময় হলে আওয়াজ উঠেছে, বোরিং! পরে ‘নাগরিক’ দেখে সমর সেন তাঁর ‘বাবু বৃত্তান্ত’ বইয়ে লিখবেন, ‘সত্যজিৎ পথিকৃৎ নিশ্চয়। কিন্তু নাগরিক আগে মুক্তিলাভ করলে ঋত্বিককেই পথিকৃৎ বলা হত।’
হাসপাতালে মধ্যরাতে মৃত্যুর সময় পাশে দুই ডাক্তার। রয়েছেন মৃণাল সেন। কয়েক দিন আগে ‘মৃগয়া’র আউটডোর থেকে ফিরেছেন। ৬ তারিখ সন্ধ্যাতেই ঋত্বিক-কন্যার ফোন, “বাবা হাসপাতালে।” মৃণালবাবু পৌঁছে দেখলেন, ঋত্বিক অচেতন। দু’ জন ডাক্তার ‘মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং’ করে কোনও ক্রমে রোগীর হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শত চেষ্টাতেও সাড়া মিলল না।
শরীর ভেঙে পড়ছিল কয়েক মাস আগে থেকেই। ডিসেম্বর মাসে বন্ড সই করে নিজেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এবং হাঁফাতে হাঁফাতে সটান মৃণাল সেনের বাড়িতে, ‘‘আর মদ খাব না।” গীতা সেনও নানা কথা বোঝালেন। উত্তরে ঋত্বিক বললেন, “জানো গীতা, মৃণাল ভাল লোক। কিন্তু ওর ভুবন সোম...ফুঃ!’
শ্যুটিং-এ ঋত্বিক
কেরিয়ারগ্রাফে মাত্র আটটি ছবি। আর কয়েকটি তথ্যচিত্র। তবু জীবদ্দশায় তাঁর প্রথম রেট্রোস্পেক্টিভ কোনও ফিল্ম ক্লাবের উদ্যোগে বা সরকারি আনুকূল্যে নয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে ১৯৬৮ সালে গাঁধী ভবনে। ‘ফিল্ম স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তখন ছাত্র। গত কয়েক দশক ধরে ‘ঋত্বিকতন্ত্র’ এবং নানা প্রবন্ধ লিখে মণি কাউল, কুমার সাহনিদের পাশাপাশি ঋত্বিককে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে কাগজে ঋত্বিকের মৃত্যুর খবর দেখে তিনি, অনন্য রায়, দীপক মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় অনেকেই ছুটে যান হাসপাতালে।
সে দিনের কথা সঞ্জয়বাবুর এখনও মনে আছে। হাসপাতালের এক নম্বর গেটে সত্যজিৎ রায়, আকাশবাণীর লোকেরা তাঁর হাতে মাইক ধরিয়ে দিয়েছে। দু’ নম্বর গেটে কাঁদছেন বিজন ভট্টাচাযর্। মৃণাল সেন, অনুপকুমারেরা ছোটাছুটি করছেন। মৃণাল সেনই রাতে সাঁইথিয়ায় ঋত্বিকের স্ত্রী সুরমা ঘটককে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়েছেন, ‘ঋত্বিক এক্সপায়ার্ড।’
সুরমা ঘটকের ট্রেন লেট। হাসপাতালে এসেছে সৎকার সমিতির ভ্যান। তখনই রুখে দাঁড়ালেন তরুণরা, ‘লরি চাই। রাজার মতো যাবেন ঋত্বিক।’ দু পক্ষে বাদানুবাদ, হাসপাতালের সামনে ক্ষুব্ধ তরুণদের পথ অবরোধ। জরুরি অবস্থা, কয়েক বছর আগে ইন্দিরা গাঁধীর ওপর তথ্যচিত্র তৈরির বরাত পেয়েছিলেন ঋত্বিক। কিন্তু কাজটা করে উঠতে পারেননি। দুই বছর আগে ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবেও সম্মানিত হয়েছিলেন। অতএব, রাস্তা অবরোধের খবর শুনে মহাকরণ থেকে সরাসরি হাসপাতালে চলে এলেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর হস্তক্ষেপেই বাদানুবাদ মিটল। লরিতে তোলা হল ফুলে ঢাকা ঋত্বিকের শবদেহ। লরির পিছনে ‘জাগো জাগো সর্বহারা অনশনবন্দি ক্রীতদাস’ গাইতে গাইতে ভক্তেরা। হাসপাতাল থেকে টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো হয়ে কেওড়াতলা শ্মশান। শুধুই তরুণরা, রাষ্ট্র বা মিডিয়ার কোনও তোপধ্বনি ছিল না সেই শেষ যাত্রায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.