শনিবারের নিবন্ধ...
জিয়া বুঝল না, জীবন তো আছে

...আমি সব কিছু হারিয়ে ফেলেছি।
...ভেতর থেকে চুরমার হয়ে গিয়েছি।
...তোমাকে ভালবাসতে গিয়ে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেললাম।
...খেতে পারছি না, কিছু ভাবতে পারছি না, ঘুমোতে পারছি না, কাজ করতে পারছি না। নিজের কেরিয়ারেরও আর কোনও দাম নেই আমার কাছে।
...আমার ভবিষ্যৎ চুরমার হয়ে গিয়েছে। এর পর বেঁচে থাকার মতো এই দুনিয়ায় আমার আর কিছুই নেই।


না, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমকালীন কোনও উপন্যাসের ব্যথাতুর নায়িকা-সংলাপকে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে তোলার আনাড়ি চেষ্টা নয়। উপরে তুলে দেওয়া লাইনগুলোর স্রষ্টা ভীষণ ভাবে জেন ওয়াই-এর প্রতীক। সাহসী। বেপরোয়া। বিন্দাস। এবং প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মঘাতী!
মেলানো যাচ্ছে না তো? স্বাভাবিক। বছর পঁচিশের জিয়া খানের আত্মহত্যা ঘাড় ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে দেশের বর্তমান প্রজন্মকে। যে প্রজন্ম বিয়ের পাশাপাশি সমান স্বচ্ছন্দ লিভ-ইন রিলেশনশিপে, যে প্রজন্ম কেরিয়ারের স্বার্থে প্রেমকে হাসিমুখে ফেয়ারওয়েল পার্টি দিয়ে দিচ্ছে, ফেসবুক প্রোফাইলে যাদের রিলেশনশিপ স্টেটাস আর প্রোফাইল পিকচার বদলায় প্রায় একই দ্রুততায়, সেই প্রজন্মের সম্পর্কের যাবতীয় সমীকরণ ভেঙেচুরে দিয়েছে দিন কয়েক আগের ভোররাতের ওই একটি ঘটনা।
প্রেমিকের কাছে উপেক্ষিত হয়ে তরুণ বলিউড অভিনেত্রীর আত্মহত্যা।
আপাতদৃষ্টিতে যে মেয়েটির কাছে সব কিছু ছিল অর্থ, খ্যাতি, মোটামুটি সাফল্য, সে কেন হুট করে এ রকম চরম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল?
উঠে যাচ্ছে খুব সহজ একটা প্রশ্ন এই যুগেও কি তা হলে প্রেমের জন্য কেউ আত্মহত্যা করে? উত্তর খোঁজা কঠিন তো বটেই। তবু কান পাতা যাক আশপাশে। কে কী বলছেন!
উত্তর কলকাতার নামী এক কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী সুদেষ্ণা মিত্র-কে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তেজিত জবাব আসে, “ধুস! এটা কী করল জিয়া? আজকের দিনে এ রকম কেউ করে নাকি?”
‘এ রকম’ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন? এ বার উত্তরের উত্তাপ যেন আরও বেশি। “মানে একটা ছেলের জন্য আমি আত্মহত্যা করে বসব? কেন? কে ও? তার আর আমাকে ভাল না-ই লাগতে পারে। তাই বলে আমি নিজের জীবনটাই শেষ করে ফেলব?”
এটা যদি হয় মুদ্রার এক পিঠ, তা হলে অন্য পিঠ? প্রেম নিবেদনের মরিয়া চেষ্টা হিসেবে হাতের শিরা কাটা আছে। ভালবাসার মানুষের রাগ ভাঙানোর জন্য আত্মহত্যার হুমকি দেওয়া আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টাও আছে।
বছর পঁচিশের অন্নপূর্ণা বসু যেমন বলছিলেন, “আমার জিয়ার কথা শুনে একটুও অবাক লাগেনি।” ‘ওহ ইয়েস অভি’ প্রজন্মের কাছে তা হলে নিবিড়, গভীর, তোমাকে-ছাড়া-বাঁচব-না জাতীয় প্রেম একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি? ব্যাখ্যা দিতে অন্নপূর্ণা আরও বললেন, “না, কখনওই নয়। আমরাও এ ভাবে ভালবাসতে পারি। তার জন্য চরম পদক্ষেপের ঘটনাও শোনা যায়।” অন্নপূর্ণার কথায়, “আমার মনে হয় জীবনের প্রথম প্রেম যেটা, সেখানে এ রকম কিছু করে ফেলার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। প্রথম প্রেমের অনুভূতির গভীরতা, প্রথম প্রিয়জনকে নিয়ে পাগলামি, তাকে নিয়ে প্রত্যাশা অনেক বেশি। আর সেই প্রেম না টেকার হতাশাও তাই তীব্র, তীক্ষ্ণ।”
অন্নপূর্ণার যুক্তির পাল্টা খুঁজতে বেশি দূর যেতে হবে না। বাইশ বছরের মিতালির কাছে প্রেম মানে যশ চোপড়া-কর্ণ জোহরের ক্যান্ডি-ফ্লস সিনেমা, মিল্স অ্যান্ড বুন রোম্যান্স। সেই মিতালি-কে জিজ্ঞেস করা হল, মৃত্যুই কি ব্যর্থ প্রেমের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ? “বইয়ে পড়তে বা সিনেমার পর্দায় দেখতে দারুণ লাগে। ‘দেবদাস’য়ের শেষ দৃশ্যে শাহরুখ, ‘তেরে বিন’ সিনেমাটায় সলমনের জন্য প্রেমিকার আত্মহত্যাযত বার দেখি, গায়ে কাঁটা দেয়।” আর জিয়া? রিল থেকে রিয়েল লাইফের জাম্প কাটটা? “সত্যি বলতে কী, সে দিন সকালে ফেসবুক খুলে খবরটা যখন প্রথম দেখলাম, বিশ্বাসই করতে পারিনি। এখনও ভাবতে পারছি না। আজকাল প্রেম নিয়ে লোকের এত ভাবার সময় আছে? এই যুগে ভালবাসাকে কেউ এত গুরুত্ব দেয়?” গলায় ভিড় করে আসা আবেগগুলোর মধ্যে যেন বিস্ময়ের ভাগ সব চেয়ে বেশি।
বিস্ময়ের ধোঁয়াশা কাটাতে চাই বিজ্ঞানের কড়া আলো। যেটা পাওয়া গেল মনস্তত্ত্ববিদ ডা. অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের কথায়। জিয়ার ঘটনা যাঁর কাছে একেবারেই অবাক করার মতো নয়। “দেখুন, মানসিক গঠনের দিক দিয়ে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা একেবারে আলাদা। হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে মেয়েদের অনুভূতি অনেক প্রখর। সেই সম্পর্ক ভাঙার ধাক্কাও তাই অনেক বেশি করে নাড়া দেয় মেয়েদের।” জিয়া যা কিছুর সঙ্গে আপস করে নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেগুলো মনে করিয়ে দিয়ে ডাঃ মুখোপাধ্যায় আরও বলেন, “ও এক জনকে গভীর ভাবে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু সেই মানুষটার জন্য ওকে গর্ভপাতের মতো চরম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েও যেতে হয়েছে। এত রকম স্তরের বিশ্বাসভঙ্গতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সবার এক হতে পারে না। বাইরে থেকে দেখে মনে হতে পারে খুব বড় বোকামি করে ফেলল মেয়েটা। কিন্তু ওর মনের মধ্যে কী কী চলছিল, সেটা কি আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব?”
তা হলে এ যুগেও লোকে প্রেমের জন্য প্রাণ দিতে পারে? কী বলছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ? “এটা ঠিক যে আগেকার প্রজন্মের চেয়ে এখনকার ছেলেমেয়েরা মানসিক ভাবে অনেক আলাদা। এই প্রজন্মের কাছে প্রেমের পাশাপাশি কেরিয়ারও সমান গুরুত্ব পাচ্ছে। অনুভূতিগুলোও আগের চেয়ে আলাদা। কিন্তু এরা তো একেবারে রোবট হয়ে যায়নি!
সুখ, দুঃখ, রাগ, ভালবাসা এদেরও আছে। তাই প্রেমে ধাক্কা খেয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার ঘটনা এই প্রজন্মের মধ্যেও আছে। এর মধ্যে আমি বিস্ময়ের কিছু দেখি না,” বলছেন ডাঃ মুখোপাধ্যায়।
বিস্ময় যদি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার একটা বড় অংশ হয়, তা হলে খুব ক্লোজ সেকেন্ড হিসেবে উঠে আসছে আর একটা মৌলিক অনুভূতি রাগ।
কী রকম?
প্রায় দশ বছর ধরে প্রেম করে গত বছর বিয়ে করেছেন মধুমিতা। প্রেমিক অবাঙালি, বাড়ির লোককে রাজি করানোটা মোটেও সহজ ছিল না। প্রেমের খাতিরে বাড়িতে নিয়মিত ঝগড়া, মান-অভিমান তাই তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত প্রেমেরই জয় হয়েছে তাঁর জীবনে। কিন্তু সেই মধুমিতাও জিয়া-এপিসোডটা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলে দিচ্ছেন, “হোয়াট এ ওয়েস্ট!”
প্রতিক্রিয়াটা সহজবোধ্য। এ ভাবে নিজের জীবন নষ্ট করার কোনও মানে হয়? ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মধুমিতা বলেনও, “সত্যি তো, জীবনটাকে কেউ এ ভাবে শেষ করে দেয়? এক জন ছেলের তোমাকে পছন্দ হয়নি, আর তাতেই জীবনটা শেষ হয়ে গেল? কেন? আর কিছুর জন্য বাঁচা যায় না? মা-বাবা, ভাই-বোন, কেরিয়ার...বাঁচার কত রকম রসদ আছে! যার কেউ নেই, সে তো নিজের জন্যও বাঁচতে পারে!”
তার উদাহরণও আছে। দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ঋতবান মজুমদার। কলেজে ঢুকে ছ’মাসের মধ্যে প্রেমে পড়েন। বছরও গড়ায়নি। প্রেম ভেঙে খান খান। মেয়েটি অন্য একজনকে ভালবেসে সম্পর্কের ইতি টানে। ঋতবান বললেন, “দেখুন, এ ঘটনাটির হ্যাংওভার এখনও আমার মধ্যে আছে। প্রথম দিকে অসম্ভব ডিপ্রেসড থাকতাম। খুব একা লাগত। সত্যি, মনে হত বেঁচে থেকে কী লাভ! এখন হয়তো সেটা নয়। বন্ধুরা খুব হেল্প করেছে। বাবা-মা-দিদিও। একটা সময় বুঝতে পেরেছি, শুধু নিজের জন্যই তো বাঁচা যায়! কিন্তু অন্য কোনও বান্ধবীর সঙ্গে আবার যে জড়িয়ে পড়ব, তা’ও এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারি না। অথচ তেমন সুযোগ যে আসেনি, তাও নয়।”
একটু অন্য কথা শোনা গেল সৌম্যদীপ্তর বক্তব্যে। বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করা সৌম্যদীপ্ত বলছেন, “প্রেম অবশ্যই জরুরি। আমি আমার প্রেমিকার জন্য অনেক কিছু করতে পারি। ফুটবল ম্যাচ না দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শপিং করতে পারি, নিজের পছন্দের সিনেমা দেখার আগে বান্ধবীর পছন্দের নাটক দেখতে যেতে পারি। আবার ও-ও আমার কথা ভেবে ক্রিকেট-ফুটবল নিয়ে আগ্রহ দেখানোর চেষ্টা করে। মেসির স্টেটাস উল্টে-পাল্টে দেখে।”
মানে, পরস্পরের পৃথিবী শেয়ার করে নেওয়াটা এদের দুনিয়ায় আদর্শ ভালবাসার নিদর্শন। যে দুনিয়ায় আত্মহত্যার মতো চরম কিছুর উপস্থিতি ভাবাই যায় না। ঝগড়া-টগড়া হলে, বা খুব একা লাগলে কখনও ভেবেছেন আত্মহত্যার কথা? “পাগল! ঝগড়া তো যে কোনও সম্পর্কেই হয়। আর যদি কোনও কারণে সম্পর্কটা না-ও টেকে, তা হলে তার জন্য খামোখা নিজের জীবনটা শেষ করার কথা ভাবব কেন? জীবন কি অতই সস্তা? আর প্রেমই কি জীবনের সব? পরিবার আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে, কেরিয়ার আছে। বাঁচার জন্য কত কিছু আছে!”
মিতালি-সৌম্যদীপ্তর কাছে অবশ্য জিয়ার আত্মহত্যার চেয়েও বড় বিস্ময় ব্যর্থ প্রেমের আগুনে নিজেকে এ ভাবে পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়া। “মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যা তা-ও মেনে নেওয়া যায়। বা জীবনে যদি খুব বড় কোনও অঘটন ঘটে যায়... কিন্তু প্রেমে ধাক্কা খেয়ে আত্মহত্যা করার মতো অর্থহীন আর কিছু হতে পারে না,” বলছেন মিতালি। আর সৌম্যদীপ্তর বক্তব্য, “একটা ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক টিকল না বলে কি আমার জীবনে সেখানেই ফুলস্টপ পড়ে গেল? জিয়ার বয়সই বা এমন কী ছিল? দু’বছর পরে আরও ভাল কোনও ছেলের সঙ্গে ওর দেখা হত না, তার কী গ্যারান্টি আছে? প্রেমটা ওর কাছে এত বড় হয়ে গেল যে তার সামনে নিজের জীবনের কোনও দামই থাকল না? নাহ্, এটাকে বোকামি ছাড়া কিছু বলা যায় না।” এ প্রসঙ্গে ডা. মুখোপাধ্যায় আবার বললেন, “জীবনে বা ভালবাসায় ব্যর্থতা আসবে না, এটা হয় নাকি? ব্যর্থতা আর দুঃখের আগুনে পুড়েই তো খাঁটি সোনা হয়। ব্যর্থতার হাহাকার থেকেই তো জন্মায় কিংবদন্তি সাহিত্য-শিল্প-গান। ব্যর্থতা মানুষকে আরও শিক্ষিত করে। পরিণত করে।”
জিয়া-কাণ্ডে সম্ভবত সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যটা এসেছে বলিউডি রোম্যান্সের রাজপুত্রের মুখ থেকে। “দেয়ার আর নো লিমিটস হোয়েন ইট কামস টু লাভ...বাট লেট নট লাভ বিকাম মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান লাইফ,” বলছেন শাহরুখ খান।
হয়তো ঠিকই বলেছেন কিং খান। ভালবাসার কোনও গণ্ডি নেই। তাকে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টাও অর্থহীন। কিন্তু জীবনের চেয়ে প্রেমকে বেশি গুরুত্ব দেওয়াও হয়তো উচিত নয়। তাতে তো দুইয়েরই অপমান। জীবনের, ভালবাসারও।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.