গুলির দাগ এখনও মিলিয়ে যায়নি, নেতাই এক দলেরই হাতে
ংসাবতীর তীরে কৃষিপণ্যের দোকানটার দেওয়ালের গায়ে ছেঁদাগুলো বোজানোর চেষ্টা হয়েছে সিমেন্ট দিয়ে। কিন্তু সেই তাপ্পির পরেও থ্রি-নট-থ্রি বুলেটের চিহ্নগুলো চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। দোকানের পূর্ব দিকে পঁচিশ গজ দূরের রংচটা গোলাপি রঙের দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে এলোপাথাড়ি ছোড়া হয়েছিল গুলি। রথীন দণ্ডপাটের ওই বাড়ি বা সিপিএমের সেই ‘হার্মাদ ক্যাম্প’ এখন এক রকম পরিত্যক্ত। তবে গ্রামের কিছু দেওয়ালে বুলেটের বহু ক্ষতচিহ্ন আজও ২০১১-র ৭ জানুয়ারির সেই হত্যালীলার দগদগে স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে।
বুলেটের চিহ্নগুলোর মতোই নিহত ন’জনের পরিবারের অন্তরের দগদগে ঘা কোনও মলমেই সারার নয়। রঞ্জিত পাত্রের যেমন। ছোট ছেলে, বছর কুড়ির অরূপকে যিনি হারিয়েছেন, সেই সকালের গুলিবৃষ্টিতে। রঞ্জিতবাবুর কথায়, “কিছু ভাল লাগে না জানেন, কিছুই ভাল লাগে না। আমার তো দিন শেষ হয়ে এল, শরীরটা একেবারেই ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু আমার ছেলেটা? আমরা কি জানতাম, ওরা নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপরে গুলি চালিয়ে দেবে? আমরা তো গিয়েছিলাম প্রতিবাদ জানাতে। ওরা গ্রামের অল্পবয়সি ছেলেদের অস্ত্রপ্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করছিল, জুলুম করছিল।”
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেতাইয়ে জয়ী তৃণমূলের সরণজিৎ রায়। ছবি দেবরাজ ঘোষের তোলা।
সেই সশস্ত্র শিবিরও আর নেই, সেই সিপিএমের রাজ্যপাটও আর পশ্চিমবঙ্গে নেই। তা বলে জুলুম এখনও বন্ধ হয়নি নেতাইয়ে। গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে নেতাইয়ে নিয়মিত পাক দিচ্ছে বর্তমান শাসকদলের বাইকবাহিনী। আরোহী, চালকদের মাথায় ও মুখে ফেট্টি। পাশের গ্রাম ডাইনটিকরির সিপিএম পঞ্চায়েত প্রার্থী নেতাইয়ে তাঁর এক কমরেডের সঙ্গে সম্প্রতি মামুলি আড্ডা মারতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওই কমরেড মুখ ঘুরিয়ে চলে যান। পরে মোবাইলে জানিয়ে দেন, তৃণমূলের লোকজন দেখে ফেললে বিপদ আছে বলে তিনি কথা বলেননি, কমরেড যেন কিছু মনে না-করেন। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরেও নেতাইয়ে রাজনৈতিক জুলুমবাজি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সিপিএমের সশস্ত্র শিবিরের সেই কালান্তক চেহারা নেই ঠিকই, কিন্তু শাসক দলের রাজনৈতিক একাধিপত্য কায়েম করার প্রচেষ্টা নেতাইয়ের মানুষকে আজও মুক্তি দেয়নি। পতাকার রংটাই যা কেবল পাল্টেছে। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটা ভোটও পড়ার আগেই নেতাইয়ে গ্রাম পঞ্চায়েত আসনটা পকেটে পুরে নিয়েছে তৃণমূল।
মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ১০ জুন যেটা দেখা যায়, তৃণমূলের সরণজিৎ রায় ছাড়া লালগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের এই নেতাই আসনে আর কোনও প্রার্থী নেই।
তা বলে নেতাইয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোনও প্রার্থী পাওয়া যায়নি এমনটা কিন্তু নয়। কংগ্রেসের হয়ে এই আসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন উত্তম জানা। ১০ তারিখ একেবারে শেষ দিন দুপুরে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন।
কেন? স্থানীয় তৃণমূল নেতা তন্ময় রায়ের বক্তব্য, “আসলে উত্তম আমাদের দল-ই করত। কংগ্রেসের কেউ কেউ ওকে ভুল বুঝিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। পরে সম্ভবত ওর বিবেকদংশন হয়েছে। আমরাও ওকে বুঝিয়েছিলাম, তৃণমূল যেখানে ক্ষমতায় এসে এত কিছু উন্নয়নের কাজ করছে, সেখানে কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়ানো ঠিক হচ্ছে কি না।”
উত্তমের কথায়, “আমার বাবা খুব অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আমার নিজের শরীরও ভাল নয়। সব দিক আমাকেই দেখতে হয়। বাড়ি থেকে বলল, আমি রাজনীতি করতে গেলে বাড়ির অবস্থা কী হবে? তাই সব দিক বিবেচনা করে সরে দাঁড়িয়েছি।” কিন্তু মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়ে সে কথা মাথায় ছিল না? “আসলে গ্রামে তৃণমূলের কয়েকজনের সঙ্গে আমার গণ্ডগোল হয়। সেই রাগ থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।”
উত্তমের মা ভদ্রা জানা বলেন, “কেউ কিছু জোর করেনি বাবা, বিশ্বাস করো। আমরাই ছেলেকে বললাম, কেন তুমি রাজনীতিতে জড়াতে যাচ্ছ, যেখানে তোমার বাড়ির এই অবস্থা, বাবা অসুস্থ!” যিনি উত্তমের পোলিং এজেন্ট হয়েছিলেন, কংগ্রেসকর্মী সেই ভনতা ধীবর কিন্তু দাবি করেছেন, “সব মিথ্যে। উত্তম বা ওর বাড়ির লোক ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। দিনের পর দিন ওকে তৃণমূলের লোকজন গিয়ে হুমকি দিচ্ছে, আমি ওর এজেন্ট হয়েছিলাম বলে আমার বাড়িতে বেশ কয়েকবার পুলিশ পাঠিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে। তার পরেও ও কিন্তু মনোনয়ন প্রত্যাহার করেনি।”
তা হলে শেষ দিন উত্তমের মনোনয়ন প্রত্যাহার হল কী করে? “আমরা কংগ্রেসের ছেলেরা সব সময় ওকে ঘিরে রাখছিলাম। ১০ তারিখ দুপুরে আমরা আর কিছু গণ্ডগোল হবে না ভেবে স্নান-খাওয়া করতে গেলাম। সেই সুযোগে উত্তমকে একা পেয়ে ওকে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী রীতিমতো জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাল। এটা কি গণতন্ত্র?” প্রশ্ন ভনতার।
বিনা ভোটেই ফয়সালা হয়ে যাওয়া নেতাইয়ের ওই গণতন্ত্রের লড়াইয়ে নিজেরা অংশ না-নিলেও তৃণমূলের যাত্রাভঙ্গ করার মতলবে ছিল সিপিএম। গণহত্যার ঘা মানুষের মন থেকে এখনও শুকোয়নি বলে অনেক ভেবেচিন্তে নেতাইয়ে তারা প্রার্থী দেয়নি। পার্টির লালগড়ের নেতা তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ঠিক করেছিলাম, নেতাইয়ে কংগ্রেসের প্রার্থীকেই সমর্থন করব। কিন্তু তৃণমূল সন্ত্রাস চালিয়ে ওই প্রার্থীকে জোর করে তুলে নিল।”
গত বিধানসভায় নেতাইয়ে ভোট পড়েছিল প্রায় ১১০০, যার মধ্যে তৃণমূল-ই পেয়েছিল ৯০০ ভোট। নেতাই-কাণ্ডের স্মৃতি তাজা থাকলেও সিপিএম কিন্তু ১৫০ ভোট পেয়েছিল। তবে সেই সময়ে কংগ্রেস আর তৃণমূলের জোট ছিল এবং নেতাইয়ে বরাবর কংগ্রেসের একটা পুরনো এবং নিখাদ ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। এখন তার সঙ্গে শাসক দলের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও প্রতিশ্রুতি পালন করতে না-পারার ক্ষোভ যোগ হয়েছে। ক্ষোভের তালিকার শীর্ষে রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও লালগড় থেকে নেতাই পর্যন্ত এখনও পাকা সড়ক না-হওয়া। এমনকী তৃণমূল সমর্থক, একটি ছোট চা-মিষ্টির দোকানের মালিক পল্টু দণ্ডপাটও বলেন, “আমার মতো গরিবের অবস্থার কোনও পরিবর্তন কিন্তু হয়নি। আর অন্য দিকে, বড়লোকেরা আরও ফুলে-ফেঁপে উঠছে, তাদের বাড়ির ছেলেরাই চাকরি পাচ্ছে। তেলা মাথায় তেল দেওয়া চলছেই।”
এই সব কারণেই কি নেতাইয়ে বিরোধী প্রার্থীর মনোনয়ন জোর করে তুলিয়ে নেওয়া হল?
লালগড়ের তৃণমূলকর্মী শ্যামল মাহাতো অবশ্য বলেন, “জোর করিনি তো। আমরা বোঝাচ্ছি। বলছি, এই সরকার দু’বছর এসেই জঙ্গলমহলের জন্য এত কাজ করে দিল, সেখানে বিরোধী দলের হয়ে দাঁড়ানোটা কি
ঠিক হচ্ছে?” নেতাইয়ের হতদরিদ্র বাসিন্দা যদু ধীবরের কথায়, “উত্তম জানা কী করবে? তৃণমূল বলে দিয়েছে, এখানে একটাই দল থাকবে।”
অতএব জোর যার, শেষ বিচারে নেতাইয়ের মুলুক এখনও তারই।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.