নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের তদন্তে নেমে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কেন সিবিআই জেরা করল না, এ বার কলকাতা হাইকোর্টেও তা নিয়ে প্রশ্ন তুলল রাজ্য সরকার।
নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনায় সিবিআই-তদন্তের গতি-প্রকৃতিতে রাজ্য সরকার যে সন্তুষ্ট নয়, সরকারের তরফে শুক্রবার তা আদালতকে জানানো হয়েছে। হাইকোর্টে জমা দেওয়া সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে সরকার এ-ও প্রশ্ন তুলেছে, নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর দিন ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ অফিসারেরা যে সব জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁদের কেন মামলায় ছাড় দেওয়া হল? এবং সিবিআইয়ের দেওয়া ব্যাখ্যায় এ সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব না-থাকাতেই তিন পুলিশ-কর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের অনুমতি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটিকে দেওয়া হয়নি বলে রাজ্য সরকার এ দিন হাইকোর্টকে জানিয়ে দিয়েছে।
সিবিআইয়ের নন্দীগ্রাম-তদন্তে রাজ্যের ‘অসন্তোষের’ কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সরকারপক্ষের কৌঁসুলি সুব্রত তালুকদার এ দিন আদালতকে বলেন, নন্দীগ্রামে গুলিচালনায় পুলিশের যে সব উচ্চ কর্তাব্যক্তি যুক্ত বলে অভিযোগ, সিবিআই তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও তদন্ত করছে না। এমনকী, ঘটনায় যে সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে, সিবিআই তাঁদের বিরুদ্ধেও ঠিকঠাক তদন্ত করছে না বলে সরকারপক্ষের দাবি। “রাজ্য সরকার বার বার ওই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তের সুপারিশ করেছে। কিন্তু সিবিআই আমল দেয়নি। তারা তাদের মতো তদন্ত চালিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে। তাতে রাজ্য সন্তুষ্ট নয়। তাই তারা তিন অফিসারের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের অনমুতি দেয়নি।” বলেন সুব্রতবাবু।
নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি হাইকোর্টে আলাদা মামলা করে জানতে চেয়েছিলেন, ঘটনাটি সম্পর্কে সিবিআই-তদন্ত কতটা এগিয়েছে। তার প্রেক্ষিতে বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি মৃণালকান্তি রায়চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চ সিবিআই-কে অন্তর্বর্তী রিপোর্ট জমা দিতে বলে। বৃহস্পতিবার জমা পড়া সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে তিন পুলিশ-কর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের জন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের তরফে রাজ্যের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল ২০১২-র ৫ ডিসেম্বর তারিখে। রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন তুলে সিবিআইয়ের কাছে তার ব্যাখ্যা চায়। গত ১৭ এপ্রিল সিবিআই রাজ্যের কাছে সেই ব্যাখ্যা পেশ করেছে। কিন্তু তার পরে দু’মাস কেটে গেলেও সরকারের দিক থেকে চার্জশিট দাখিলের সবুজ সঙ্কেত মেলেনি বলে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর কৌঁসুলি আদালতকে অবহিত করেন। তার ভিত্তিতে ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, রাজ্য সরকার এখনও কেন তিন অফিসারের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের অনুমোদন দিল না, শুক্রবারের মধ্যে তা আদালতকে জানাতে হবে।
সেই মতো এ দিন ডিভিশন বেঞ্চে রিপোর্ট পেশ করেছে রাজ্য, যাতে সিবিআইয়ের নন্দীগ্রাম-তদন্ত সম্পর্কে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের তরফে রিপোর্টে সই করেছেন স্বরাষ্ট্র (কর্মীবর্গ) দফতরের অফিসার-অন-স্পেশ্যাল-ডিউটি শর্মিষ্ঠা ঘোষ। ডিভিশন বেঞ্চ সিবিআই-কে বলেছে আগামী ২৫শে জুন রাজ্যের বক্তব্যের ব্যাখ্যা-সহ তাদের জবাব জমা দিতে।
সিবিআইয়ের ব্যাখ্যায় কেন রাজ্য খুশি নয়, তা বোঝাতে গিয়ে রিপোর্টে মূলত চারটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। কী কী?
সরকার মনে করে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশেই ২০০৭-এর ১৪ মে নন্দীগ্রামে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। তবু সিবিআই তাঁকে জেরা করল না কেন, সরকারের তা বোধগম্য হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে সিবিআই ১৭ এপ্রিল যে ব্যাখ্যা মহাকরণে পাঠিয়েছে, তাতেও সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
রাজ্যের আরও অভিযোগ: নন্দীগ্রামে গুলিচালনার দিন (২০০৭-এর ১৪ মার্চ) পুলিশ অবৈধ ভাবে চারটে মোবাইল ফোন নিয়েছিল, যেগুলোর মাধ্যমে ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ-কর্তারা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে গুলিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। এ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যুরো বিষয়টি ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি বলে সরকারের অভিযোগ। পাশাপাশি রাজ্যার রিপোর্ট বলছে, এত বড় একটা অভিযানে যে ধরনের পুলিশি ব্যবস্থা থাকা উচিত, তা ছিল না। অথচ সিবিআই-তদন্তে এই গাফিলতির দিকে নজর দেওয়া হয়নি। উপরন্তু সরকারের দাবি, ওই দিন পুলিশি অভিযানে বহু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার হলেও সিবিআই-তদন্তে তা নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই।
২০০৭-এর ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর পরে ১৭ মার্চ কলকাতা হাইকোর্ট ঘটনার তদন্তভার সিবিআই-কে দেয়। সরকারি সূত্রের খবর: ২০১২-র মে মাসে সিবিআই প্রথম তদন্ত-রিপোর্ট জমা দিয়ে তিন পুলিশ-কর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের অনুমতি চেয়েছিল। সরকার মানেনি। ফের অনুমতি চেয়ে সিবিআই চিঠি দেয় গত বছরের নভেম্বরে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সিবিআই-কে চিঠি দিয়ে পাল্টা প্রস্তাব দেয়, নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কয়েক জন পুলিশ অফিসারের ভূমিকা ফের খতিয়ে দেখা হোক। রাজ্যের প্রশ্ন ছিল, যে জায়গায় ১১ জন নিহত হল সেখানে কারও বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের সুপারিশ না-করে যেখানে কম লোক নিহত হল, সেখানকার তিন অফিসারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হবে কেন? রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রীরা ছাড় পাবেন কেন, সে প্রশ্নও তোলা হয়।
উত্তরে সিবিআই জানিয়ে দিয়েছিল, নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে বুদ্ধবাবুর বিরুদ্ধে তেমন কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। সব মিলিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের ১২ জন কর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। প্রতিক্রিয়ায় মহাকরণ জানায়, বেশ কয়েক জন অফিসারের বিরুদ্ধে ‘লঘু শাস্তি’র সুপারিশ করা হয়েছে, যাঁদের ভূমিকা আবার খতিয়ে দেখা হোক। কিন্তু ১৭ এপ্রিলের ব্যাখ্যা-রিপোর্টে সিবিআই জানিয়ে দেয়, ওই অফিসারদের বিরুদ্ধেও বিনা প্ররোচনায় গুলিচালনার সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলেনি।
এই জবাব যে মহাকরণকে আদৌ খুশি করতে পারেনি, হাইকোর্টে এ দিন সেটাই পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। মহাকরণের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “আমরা চেয়েছিলাম, নন্দীগ্রামে গণহত্যার জন্য দায়ী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তি হোক। কিন্তু সিবিআই তাঁদেরই ছাড় দিয়েছে। তা ছাড়া একই ঘটনায় তিন জন অফিসার শাস্তি পাবেন, আর তিন জন পাবেন না এটা কোনও ভাবে মেনে নেওয়া যায় না।” কর্তাটি বলেন, “আমরা আইনি পরামর্শ নিয়ে আমাদের বক্তব্য জানাব। তাতে দোষী অফিসারদের শাস্তি বিলম্বিত হলেও সরকারের আপত্তি নেই।”
|