স্পেন-১০ (তোরেস-৪, ভিয়া-৩, সিলভা-২, মাতা)
তাহিতি-০ |
বেশ কিছু দিন ধরে ফুটবলমহলে, বিশেষজ্ঞদের টেবলে একটা আলোচনা খেয়াল করছিলাম। বার্সেলোনা তখন পরপর হারছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে চার গোল খেয়েছে। অনেকেই দেখছিলাম বলাবলি করছেন যে, তিকিতাকা শেষ। বলছেন যে, জাভি-ইনিয়েস্তাও শেষ। ওদের যুগ শেষ হল মানে, এ বার স্পেনের রাজত্বও বিলুপ্তির পথ ধরবে।
বৃহস্পতিবার রাতে স্প্যানিশ আর্মাডাদের ও রকম বিধ্বংসী ফুটবল দেখার পর, ওই সমালোচকদের মুখগুলোও খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। খুব সহজে বলি তিকিতাকা যেমন ছিল, তেমনই আছে। জাভি-ইনিয়েস্তারা থাকলে যেমন লা রোজাদের মাঝমাঠকে ভয়ঙ্কর দেখায়, ওরা না থাকলেও ঠিক ততটাই দেখায়। মাতা, কাজোরলা, নাভাস-রা ভবিষ্যতে জাভি বা ইনিয়েস্তা হয়ে উঠতে পারবে কি না, সময় বলবে। কিন্তু যেটা এখনই লিখে ফেলা যায় তা হল, স্পেনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিন্তু তৈরি।
আরও একটা জিনিস এখনই লিখে ফেলা যায়। দেল বস্কির স্পেন কিন্তু তিকিতাকার সঙ্গে আরও একটা ঘরানা ধীরে ধীরে আমদানি করছে। রেনাঁস মিশেলসের টোটাল ফুটবল! এদের প্রতিটা পাস নিখুঁত। অধিকাংশ প্লেয়ার বিভিন্ন পজিশনে অনায়াসে খেলে দিতে পারে। প্রতিটা মুভমেন্ট সঠিক। |
ভেবে দেখুন, তাহিতির বিরুদ্ধে কোনও জাভি বা ইনিয়েস্তা ছিল না। শেষের দিকে ইনিয়েস্তা নামলেও রিজার্ভ বেঞ্চের ফুটবলারদের নিয়েই প্রথম দল গড়েছিলেন দেল বস্কি। অথচ প্রথম দলে সুযোগ পেয়ে মাতা, কাজোরলারা নিজেদের প্রতিভার প্রমাণ রাখল। দশ-দশটা গোল হল! অনেক দিন বাদে তোরেস আর ভিয়াকে একসঙ্গে দেখে ভাল লাগল। দুজনেই বিশ্বমানের স্ট্রাইকার। ফর্ম না থাকলেও হ্যাটট্রিক করে দুজনেই দেখাল এখনও অনেক ফুটবল বাকি আছে ওদের মধ্যে। আর এই দশটা গোলের দশটাই আদতে দলগত কৃতিত্বের উদাহারণ। এখানেই স্পেনের সঙ্গে অন্য দেশের তফাত। আর্জেন্তিনা বা পর্তুগালের সাফল্য পুরোটা না হলেও, অনেকটাই নির্ভর করে লিওনেল মেসি বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ওপর। কিন্তু স্পেন কোনও ব্যক্তিগত প্রতিভার ওপর নির্ভর করে না। ওরা বিশ্বাস করে টিম গেমে।
বিশ্বকাপের পরে দেল বস্কি অবসর নিলে কিছুটা হলেও ক্ষতি হবে স্পেনের। সাম্প্রতিক কালে স্পেনের সাফল্যের পেছনে মূল মস্তিষ্ক দেল বস্কিরই। বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে ইউরো প্রতি টুর্নামেন্টেই নিজের স্ট্র্যাটেজির মাস্টারস্ট্রোক দেখিয়েছেন দেল বস্কি। এক সময় ‘চোকার্স’ তকমা পাওয়া দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন তিনি। একটা দলকে সেরা তখনই বলা যায় যখন তারা একটা ট্রফি জিতেই থেমে থাকে না। বরং বারবার চেষ্টা করে যে আগের বারের চেয়ে বেশি ভাল খেলতে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খিদেই কিন্তু স্পেনকে সাহায্য করছে ট্রফির পর ট্রফি ঘরে তুলতে।
দশ গোল হজম করলেও তাহিতিকে বাহবা দেব কনফেডারেশন কাপের মতো এক বিশ্ব মঞ্চে সুযোগ পাওয়ার জন্য। কনফেড কাপের আগে অনেকে জানতই না তাহিতি বলে কোনও দেশ ফুটবল খেলে। কিন্তু টুর্নামেন্ট শেষে আর কিছু না হোক, সবার শ্রদ্ধা নিয়ে অবশ্যই বিদায় নেবে তাহিতি। কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে যদি আরও কয়েকটা টুর্নামেন্ট খেলে তা হলে ওদের অবশ্যই আরও উন্নতি হবে। তাহিতি বা ভারতের মতো র্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে থাকা দলগুলোর সমস্যা শুধুমাত্র অনভিজ্ঞতা নয়, মানসিকতার তফাতও। দেখছিলাম তাহিতি কিপার ভিয়ার একটা ফ্রিকিক বাঁচিয়ে হাত মুঠো করে ঝাঁকাচ্ছিল। সেটা কেন হবে? যতই তোমার উল্টো দিকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিম খেলুক, সে তো তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তুমি কেন তাদের বিরুদ্ধে হীনমন্যতায় ভুগবে?
আসলে তাহিতি বা ভারতের মতো বিশ্বফুটবলে লিলিপুট পর্যায়ের টিমগুলোর মুশকিল হচ্ছে, দেশে এরা ভাল মাঠ পায় না। পরিকাঠামো বলে কিছু নেই। একেবারে গ্রাসরুট পর্যায় থেকে ফুটবলার তুলে আনার চেষ্টা নেই।
তবু তো তাহিতি কনফেড কাপে খেলছে, স্পেনের বিরুদ্ধে খেলার একটা অভিজ্ঞতাও হল। আমাদের তো সেটাও হয় না! সারা জীবন শুধু স্পেন, জার্মানির প্রশংসা করেই কাটাতে হয়! |