তাঁরা বদলে ফেলতে চান নিজের প্রাকৃতিক অস্তিত্ব। প্রকৃতির হিসাব উলটে দিতে চান। হতে চান নতুন মানব বা মানবী। কিন্তু বদলানো কি অতই সহজ?
তাতে কী? বদলের পথে যত প্রতিরোধ, তত একবগ্গা রূপান্তরকামীরা। তবু, অনায়াসে কি মোছা যায় প্রকৃতির বসিয়ে দেওয়া সিলমোহর?
মানালির কথা দিয়ে শুরু করা যাক। কলকাতাতেই জন্ম, বড় হওয়া। বয়ঃসন্ধি থেকে নিজের আমিত্ব নিয়ে শোচনীয় ধন্দের সূত্রপাত। অভিভাবকদের সঙ্গে, আত্মীয়-পরিজন-পাড়ার লোকের সঙ্গে শুরু তুমুল সংঘাত। কত বড় স্পর্ধা মেয়ের যে, মেয়েলিপনার বদলে ছেলেদের মতো হতে চায়!
এক রাতের গল্প শোনাচ্ছিলেন মানালি। বাড়িতে নিজের ঘরে এক বান্ধবীকে নিয়ে আছেন। আচমকা মনে হল যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ খুলে দেখেন অন্ধকারে কয়েকটা ছায়ামূর্তি। এক জন একটা বালিশ তাঁর মুখে চেপে ধরেছিল।
ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট মানালির পক্ষে চার জনকে কাবু করতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু জানতে পারেন, তাঁকে ‘শিক্ষা’ দিতে তাঁর বাবাই ভাড়াটে গুন্ডা এনেছিলেন! ঘেন্নায়, দুঃখে পুলিশের কাছে যাননি, তবে বাড়ি ছেড়েছিলেন।
মানালির কথা খুব স্পষ্ট, “প্রকৃতিকে অস্বীকার করে নিজের মতো চলতে ধক লাগে। নিজের ক্ষমতাটা আঁচ করতে হয়। প্রতি মুহূর্তে সবার ব্যঙ্গ, কৌতূহল, বিদ্রুপ, ঠাট্টা উড়িয়ে লড়াই চালাতে পারব তো? দরকার আর্থিক স্বাবলম্বন, সেটা আছে তো? তবে বদলের পথে হাঁটা দরকার। পথটা বড় পাথুরে।”
শারীরিক সমস্যা থাকায় পুরোপুরি লিঙ্গ পরিবর্তন বা হরমোন থেরাপি নিতে পারেননি মানালি। কিন্তু ঋতুবন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য জরায়ু বাদ দিতে হবে। বললেন, “প্রায় সব মেট্রো শহরের নামী চিকিৎসকদের কাছে গিয়েছি। এক দল ডাক্তার ফতোয়া দিয়ে দিলেন, আমাদের দেশে অবিবাহিত মেয়েদের নাকি জরায়ু বাদ দেওয়ার নিয়ম নেই! আরেক দল বললেন, বিয়ের পর স্বামী অনুমতি দিলে তবে এটা সম্ভব। শেষ পর্যন্ত দিল্লির এক হাসপাতালের একজন বাঙালি মহিলা ডাক্তার রাজি হন। গত বছর ৪ মে অপারেশন হয়ে গিয়েছে।
ইন্টারভিউ দিতে দিতে কাফেটেরিয়ার চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে মানালি বলেন, “দেখুন-দেখুন, লোকের কী প্রচণ্ড কৌতূহল! ওরা যাচাই করার চেষ্টা করছে আমি বস্তুটা আসলে কী। ছেলে না মেয়ে না হিজড়ে? এই দৃষ্টিগুলোর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে কিন্তু। আমাদের দেশে অধিকাংশ অফিস এ ব্যাপারে কতটা সামন্ততান্ত্রিক ভাবতে পারবেন না। আমার ‘সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন’-এর জন্য চারটে চাকরি ছাড়তে হয়েছে।” |
কত টাকা লাগে পুরো প্রক্রিয়ায়? কোনও চিকিৎসক বললেন ৩ লাখ, কেউ আবার হিসাব দিলেন ৫ লাখের।
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সুজয় মজুমদার বলেন, টাকা একটা ফ্যাক্টর বটেই, কিন্তু প্রথমে মানসিক আর শারীরিক ভাবে একজনকে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করতে হবে। দু’জন মনোবিদ কাউন্সেলিং করে দেখবেন, ব্যক্তিবিশেষের লিঙ্গ পরিবর্তনের প্রকৃত তাগিদ বা প্রয়োজনীয়তা কতটা আছে। তাঁদের থেকে ছাড়পত্র মিললে তবে শুরু হবে হরমোন থেরাপি। পরবর্তী পর্যায়ে আসবে স্তন ছোট বা বড় করা, যোনি বা পুরুষাঙ্গ তৈরির ব্যাপার। এই স্তরে পৌঁছনোর আগেই অনেকেই ধৈর্য রাখতে না-পেরে, কিংবা শারীরিক ধকলে নাজেহাল হয়ে চিকিৎসা বন্ধ করেন। কেউ আর্থিক ভাবে টানতে না-পেরে অবসাদে তলিয়ে যান।
সুজয়বাবুর কথায়, “যাঁদের ডায়বেটিস, হাইপার টেনশন, আর্থ্রারাইটিস, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা রয়েছে, তাঁদের হরমোন থেরাপি দেওয়া যায় না। প্রাকৃতিক ভাবে যিনি ছেলে বা মেয়ে তাঁকে পরিবর্তন করার সময় আমরা তাঁর স্বাভাবিক হরমোন উৎপাদন আটকে দিতে পারি। কিন্তু নতুন হরমোন উৎপন্ন করতে পারি না। সেটা বাইরে থেকে বেশি পরিমাণে দীর্ঘদিন দিয়ে যেতে হয়। এতে প্রচুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।” যেমন?
প্লাস্টিক সার্জন মণীশমুকুল ঘোষ ব্যাখ্যা দেন, “কোনও ছেলে যদি মেয়ে হতে চান তা হলে তাঁকে মেয়েলি হরমোন ‘ইস্ট্রোজেন’ প্রচুর নিতে হবে। ইস্ট্রোজেন বেশি নিলে রক্ত জমাট বাঁধার একটা আশঙ্কা থাকে। হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। আবার কোনও মেয়ে যদি ছেলে হতে চান তা হলে তাঁকে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন নিতে হবে। সেই সঙ্গে ইস্ট্রোজেন কমাতে ওভারি কেটে বাদ দিতে হবে। এতে মাংসপেশির সমস্যা, স্ত্রীরোগ, লিভার ফেলিওর, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা হতে পারে।”
মণীশমুকুল জানান, হরমোন থেরাপির পর আসে স্তন গঠন বা বর্জন এবং যৌনাঙ্গের পরিবর্তন-পর্ব। এটা করতে গিয়ে স্তনের সংক্রমণ হতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে হাত বা পায়ের থেকে মাংস নিয়ে পুরুষাঙ্গ তৈরি করা হয়। কিন্তু তাতে কোনও অনুভূতি থাকে না। কোনও ‘ইজাকুলেশন’ হয় না। ছেলেদের ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গের ভিতরের মাংসপেশি বাদ দিয়ে শুধু চামড়াটা উল্টে দিয়ে যোনিপথের মতো তৈরি করা হয়। সেখানেও অনুভূতি থাকে না এবং সঙ্গমের পক্ষে তা অনেক সময় ছোট হয়। এই সব সমস্যার জন্য তৈরি থাকতে হবে।
সব কিছু জেনেও হরমোন থেরাপির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভবানীপুরের রঞ্জিত (এখন রঞ্জিতা)। রূপান্তরকামীদের কাউন্সেলিং, অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা, আইনি সাহায্য দেওয়ার জন্য একটি সংস্থা চালান তিনি বেশ কয়েক বছর। বলেন, “আমি ঠিক করেছিলাম, লিঙ্গে কোনও অস্ত্রোপচার করব না। শুধু হরমোন থেরাপি নেব। কিন্তু টানা ওষুধের সঙ্গে সুষম-প্রোটিনযুক্ত খাবার খেয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক। ওষুধের বিস্তর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হয়েছে।” এখন তাঁর ক্লান্তি লাগে সব সময়, স্নায়ুর সমস্যা হচ্ছে। বলেন, “খুব ভাল করে ডাক্তার বাছাই করতে হবে। আর বয়ঃসন্ধির বদলে বেশি বয়েসে এই প্রক্রিয়া শুরু করলে ফল মারাত্মক হতে পারে।”
রঞ্জিতাই জানালেন, প্রায় প্রতিদিন তাঁদের সংস্থায় এমন অনেকে আসছেন যাঁরা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে পুরুষাঙ্গ অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে গিয়ে মারাত্মক সংক্রমণ বাঁধিয়ে বসেছেন বা লোকের কাছে শুনে নিজে-নিজে হরমোনের ওষুধ খেয়ে চূড়ান্ত অসুস্থ হয়েছেন অথবা অবৈজ্ঞানিক ভাবে হরমোন থেরাপি থামিয়ে বিছানায় পড়েছেন। এই সব কিছুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল টানা মানসিক কাউন্সেলিং ও ফলোআপ চিকিৎসা।
শারীরিক এই সমস্যাগুলোর পাশাপাশি তিস্তা বলছিলেন আইনি জটিলতার দিক নিয়েও। তিস্তা প্রায় তেরো বছর আগে ছেলে থেকে লিঙ্গ পরিবর্তন করে মেয়ে হয়েছেন। অল্প বয়সে বাড়ি ছেড়ে বার হওয়া, তার পর চাকরি ক্ষেত্রে, সামাজিক পরিধিতে নিরন্তর সংগ্রামের ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনিও। জানালেন, সামাজিক ভাবে যত সমস্যার সামনে পড়তে হয় তার দশ গুণ বেশি সমস্যা হয় রূপান্তরিত হওয়ার পর বৈধ-সরকারি কাগজপত্র পেতে। কী রকম?
ধরা যাক, কারও জন্ম সার্টিফিকেট, পড়াশোনার সার্টিফিকেট রয়েছে মেয়ে হিসাবে। সে পরে লিঙ্গ পরিবর্তন করে ছেলে হল। তখন চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সে কোন ক্যাটাগরিতে আবেদন করবে? আবার কেউ ছেলে থেকে হঠাৎ ‘মেয়ে’ হওয়ার পর জীবনবিমা করাতে চাইলে কে তাঁকে সাহায্য করবে? তাঁর পাসপোর্টের কী হবে? তিস্তার কথায়, “কেউ লিঙ্গ পরিবর্তনের পথে যেতে চাইলে কাউন্সেলিংয়ের সময় নেতিবাচক দিকগুলোর কথা খুলে বলি। বোঝানোর চেষ্টা করি, বহিরঙ্গে পরিবর্তন জরুরি নয়। মনের গহনে যে লিঙ্গে বিশ্বাসী, যে অস্তিত্বে তাঁর আস্থা তাকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসহীনতা বা দ্বন্দ্বে ভোগাও নিষ্প্রয়োজন। এতে কারও আমিত্ব বিন্দুমাত্র খর্ব হয় না।”
এর পরেও এগোনোর জেদ থাকলে অশান্তির পথে স্বাগত। পরজন্মের অপেক্ষা নয়, এ জন্মেই সেই লড়াকু বনমালীর রাধা বা রাধার বনমালী হওয়া ঠেকানো যাবে না হয়তো। |