|
|
|
|
বদ্রীনাথে আটক বহু বাঙালি, প্রশাসন ঠুঁটো |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও নয়াদিল্লি |
প্রতিদিন ভোর চারটে না বাজতেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছেন ওঁরা। চপার এসে নামছে। আবার উড়েও যাচ্ছে। কিন্তু বারাসতের শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়দের লাইন আর এগোচ্ছে না। বদ্রীনাথে ছয় দিন আটকে রয়েছেন শম্পাদেবীর সঙ্গে কলকাতা থেকে যাওয়া ৪৭ জন বাঙালি পর্যটক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে বদ্রীনাথ গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। সেখান থেকে কবে যে মুক্তি মিলবে, জানেন না শম্পাদেবী ও তাঁর সহযাত্রীরা।
কলকাতার একটি ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে ওঁরা ৪৭ জন বদ্রীনাথে পৌঁছেছিলেন ১৫ জুন বেলা সাড়ে ১১টায়। আর তার এক ঘণ্টা পর থেকে শুরু হল বৃষ্টি। একটি আশ্রমে ঠাঁই হয়েছিল গোটা দলটার। ঠিক ছিল ১৭ জুন তারা বদ্রীনাথ থেকে নেমে আসবেন। হরিদ্বার থেকে ১৯ জুনের ফেরার টিকিটও কাটা ছিল। কিন্তু ১৫ জুন দুপুরে যে ভয়াল বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তা দু’ দিন পরে যখন থামল, তখন দেখা গেল নামার সব রাস্তা বন্ধ। বন্দি হয়ে পড়েছেন সবাই।
ভ্রমণ সংস্থাটির হয়ে বদ্রীনাথে শম্পাদেবীদের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন অজয় ঘোষ। অজয়বাবু শুক্রবার বলেন, “বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর থেকে বিপদ এল চার দিক থেকে। বিদ্যুৎ চলে গেল। জল চলে গেল। এক সময়ে চলে গেল মোবাইলের টাওয়ারও। আমরা গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। অন্য জায়গায় কী হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। শুধু বুঝতে পারছি, আমরা ওই তীর্থস্থানে ৪৭ জনকে নিয়ে ফেঁসে গিয়েছি।” |
|
হেলিকপ্টারে ওঠার দীর্ঘ লাইন বদ্রীনাথে। ছবি: রয়টার্স |
অজয়বাবু বলেন, “পরশু পর্যন্ত জল ছিল না। মোবাইলের টাওয়ার পেয়েছি গত কাল। আর বিদ্যুৎ এল এ দিন সন্ধ্যার মুখে মুখে। ১৫ জুন বিকেল থেকেই বিদ্যুৎ ছাড়া কাটাতে হয়েছে দলের সবাইকে। রাতে শুধু দুই ঘণ্টার জন্য জেনারেটর চালিয়েছেন আশ্রম-কর্তৃপক্ষ। আমাদের দলে ৭৫-৭৬ বছরের বৃদ্ধরা রয়েছেন। দলের অন্তত ২৫ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। সবাই ওষুধ খান নিয়মিত। তাতে টান পড়তে শুরু করলে যে বিপদে পড়ে যাব, তা বেশ বুঝতে পারছি।”
শম্পাদেবীর আক্ষেপ, “আমাদের সাহায্য করার মতো এখানে কেউ নেই। কবে রাস্তা খুলবে, কী ভাবে হেলিকপ্টার পাব, তা বুঝতে পারছি না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি আমাদের জন্য কিছু করবেন না?” পাঁচ দিন বর্হিবিশ্ব থেকে আলাদা। তাই শম্পাদেবীরা জানতেই পারেননি মমতা বন্দোপাধ্যায় রাজ্যের দুই মন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন তাঁদের উদ্ধার করে কলকাতা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শুক্রবার রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র পৌঁছে গিয়েছেন টিহরি বাঁধের কাছে। বদ্রীনাথের রাস্তায় সড়কপথে এখন ওই পর্যন্তই যাওয়া যাচ্ছে।
দুর্যোগে রাস্তাঘাটের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনও যে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে, অজয়বাবুরা তা বুঝে গিয়েছিলেন ১৬ জুন বিকেলেই। অজয়বাবু বলেন, “কবে রাস্তা খুলবে, কী ভাবে এতগুলি লোককে নিয়ে ফিরব সে ব্যাপারে খবর দেওয়ার কেউ নেই। স্থানীয় প্রশাসন এখানে একটা কন্ট্রোল রুম পর্যন্ত খুলতে পারেনি। প্রতিদিন ভোরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছি হেলিপ্যাডের লাইনে।” সেই লাইনে গিয়ে আজয়বাবুরা দেখছেন, তাঁরা একা নয়। রয়েছেন কলকাতার বহু পর্যটক। অনেকের অবস্থা আরও খারাপ।
হেলিকপ্টার তো চলছে। তা হলে শম্পাদেবীদের বন্দিদশা কাটছে না কেন? বারাসতের ৩৮ বছরের ওই তীর্থযাত্রী বলেন, “আমরা শুনেছিলাম বৃদ্ধ, অসুস্থ, মহিলা ও শিশুদের আগে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম সুস্থ, গাঁট্টাগোট্টা লোকেরা চপারে উঠে ফিরে যাচ্ছেন। আমাদের দলের বৃদ্ধদের নিচ্ছে না। প্রতিদিন তাই একটু একটু করে উদ্বেগ বাড়ছে।” শম্পাদেবীর সহযাত্রী কলকাতার গুরুদাস চক্রবর্তীর উদ্বেগ, “গোটা এলাকাতেই জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে। খাবারেরও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এটিএম-গুলোয় টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। মোবাইলও কাজ করছে না। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে।”
স্থানীয় সূত্রের খবর, চার ধামের অন্যতম এই বদ্রীনাথে কারও মৃত্যু হয়নি বলে তুলনামূলক ভাবে সে দিকে প্রশাসনের নজর কম। উত্তরাখণ্ড সরকারের মুখপাত্র মলকেশ্বর কলকুরি বলেন, “বদ্রীনাথ তুলনায় নিরাপদ। তাই সেখানে এখনও পুরোদমে উদ্ধার কাজ শুরু হয়নি। বিপর্যস্ত এলাকা থেকে আগে উদ্ধার কাজ চলছে। শনিবার দুপুরের পর থেকে বদ্রীনাথে উদ্ধার কাজ শুরু করা হবে।” তিনি জানান, বদ্রীনাথে যাঁরা অসুস্থ ছিলেন, তাঁদের শুধু নামিয়ে আনা হয়েছে।
মলকেশ্বরের বক্তব্য, বদ্রীনাথে আটকে পড়া লোকেদের প্রথমে জোশীমঠে নামিয়ে আনা হবে। তার পরে বাসে চাপিয়ে হরিদ্বার এবং সেখান থেকে ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে। এর পুরোটাই নিখরচায়। আটক যাত্রীদের ২০০০ টাকা করে দেওয়ার কথাও জানিয়েছে উত্তরাখণ্ড সরকার। |
|
|
|
|
|