সঙ্গী নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক, কামদুনির যন্ত্রণায় ওঁরা পথে
লেজ স্কোয়্যারের মূল ফটক দিয়ে ঢুকেই বিদ্যাসাগরের মূর্তি। পাশে মাটিতে উবু হয়ে বসে সামনে সাদা চার্ট-পেপার বিছিয়ে মোটা তুলিতে স্লোগান লিখছিলেন মেয়েরা, “প্রশ্ন করলেই মাওবাদী! তাই এ বার নীরব করে দাও হে আমায়....।” লেখার ফাঁকেই সমবেত নারীকণ্ঠে আওয়াজ উঠেছে, “চোপ/ পাহাড় হাসছে/ চোপ/ জঙ্গলমহল হাসছে/ চোপ/ পশ্চিমবঙ্গ হাসছে/ হা হা হা।”
শুক্রবার বেলা তিনটে বাজতে তখনও মিনিট পনেরো বাকি। ভিড় ক্রমশ বাড়ছে কলেজ স্কোয়্যারের সামনে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই মিছিল শুরু হবে। সংখ্যা বিচার করলে এ দিনের মিছিলে উপস্থিতদের ভিড়ে পুরুষদের তুলনায় মহিলারা কম ছিলেন সত্যি। তবে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বতঃস্ফূর্ততা, আবেগ, ক্ষোভের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি-র মতো বামপন্থী নারী সংগঠনের ছকে বাঁধা প্রতিবাদের বাইরে, স্রেফ মানবিক দায়িত্ববোধের তাড়নায় এমন অনেক মহিলা এসেছিলেন যাঁদের রাজনীতির সঙ্গে সেই অর্থে কস্মিনকালে কোনও সম্পর্ক নেই।
সুটিয়া থেকে তাপসী বসু, পুষ্প মজুমদার। ডিরোজিও কলেজের ছাত্রী ঝর্না নস্কর ও রিনা খাতুন।
কামদুনির মেয়েরা প্রতিবাদের যে শুরুটা করেছিলেন তার উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যেতে সত্তর পার করা বয়স অগ্রাহ্য করে কেউ ছুটে এসেছেন, কেউ আবার এসেছেন সুদূর দিল্লি থেকে, ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে চলে এসেছেন মা, বয়ফ্রেন্ডকে টেনে নিয়ে এসেছেন কলেজ-ছাত্রী। কামদুনির ধর্ষিতা যেখানে পড়তেন সেই ডিরোজিও কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন কিছু ছাত্রী। পাশাপাশি এক সময়ে গণধর্ষণে তোলপাড় হওয়া সুটিয়া থেকে মিছিলে যোগ দিতে এসেছেন মহিলারা, তাঁদের সঙ্গে সুটিয়া কাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী নিহত বরুণ বিশ্বাসের দিদি প্রমীলা রায়। গেদে উত্তরপাড়া থেকে এসেছেন কয়েক জন মহিলা। তাঁদের গ্রামেই ধর্ষিতা হয়ে খুন হয়েছিল সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া। কামদুনির যন্ত্রণা ওঁদের টেনে এনেছে। এনেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে। মিছিলের পুরো পথটা যিনি হেঁটেছেন, কামদুনির মেয়েটির কথা ভেবে।
সাদা খোলের তাঁতের শাড়ির আঁচলটা দিয়ে গলা-কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে মিছিলে হাঁটতে শুরু করেছিলেন সুলেখা বসু। শ্যামবাজারে থাকেন। বয়স ছিয়াত্তর ছুঁয়েছে।
হাঁটুর সমস্যা রয়েছে। তা-ও মিছিলে হাঁটতে এসেছেন? সুলেখাদেবী বললেন, “আমি সাধারণ গৃহবধূ। আমার কোনও ক্ষমতা নেই, কিন্তু প্রতিবাদটুকু তো করতে পারি। মেয়েরা কি কিছু লম্পটের জন্য বাইরে বার হবে না? মুখ্যমন্ত্রী কি বুঝতে পারছেন না, তাঁর কাছে যেটা ছোট ঘটনা, একটা মানুষের কাছে তা ভয়াবহ?”
গেদে থেকে এসেছেন টিঙ্কু মজুমদার, চন্দনা মহলদার, পলি মহলদার।
অনেকটা তাঁর কথারই রেশ শোনা গেল গল্ফ গ্রিন থেকে আসা তেষট্টি বছরের শবরী চট্টোপাধ্যায়ের গলায়। “আমি আর থাকতে পারলাম না। আমি একটা মানুষ, মহিলা, শিক্ষিকা। শুধু কামদুনির ওই মেয়েটার জন্য আজ আমি এসেছি। এর জন্য আমাকে সিপিএম বলে দেগে দেওয়া হতে পারে। তাতে কিছু আসে-যায় না।” হাওড়ার শিবপুর থেকে এসেছিলেন ভারতী বন্দ্যোপাধ্যায়। ডান পা পোলিও আক্রান্ত। অফিসে সিএল নিয়ে গোটা মিছিল হেঁটেছেন ক্রাচে ভর দিয়ে। দিল্লি থেকে এসেছেন মনস্তত্ত্বের অধ্যাপিকা তাপসী চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, তাঁর নিজের বোনঝি এক সময় ধর্ষিতা হয়ে খুন হন দুর্গাপুরে। সেই সময় বিচার পাননি। তেমন ভাবে প্রতিবাদও করতে পারেননি। এখন তারই প্রায়শ্চিত্ত করেন ধর্ষিতাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে। দিল্লির গণধর্ষিতার জন্য পথে নেমেছিলেন। তিন-চারদিন আগে কামদুনিও ঘুরে এসেছেন।
গল্ফ গ্রিন থেকে শবরী চট্টোপাধ্যায়। ৭৬ বছরের সুলেখা বসু।
তাঁদের সামনেই প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিতে-দিতে হাঁটছিলেন সুটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদী মঞ্চের প্রধান তথা সুটিয়া কাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী নিহত বরুণ বিশ্বাসের দিদি প্রমীলা রায়। সঙ্গে সুটিয়া থেকেই আসা পুষ্প মজুমদার, তাপসী বসুরা। প্রমীলা ফুঁসছিলেন, “আমার ভাইয়ের হত্যাকারীর বিচার চাই। সুটিয়ায় এখনও মেয়েরা নিরাপদ নয়। কেন মুখ্যমন্ত্রী একবারের জন্য সেখানে গেলেন না?” ফুঁসছিলেন গেদে থেকে আসা চন্দনা, পলি, টিঙ্কুরা। তাঁদের কথায়, “তেরো বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করে দিল। আমরা সন্ধেবেলা বেরোতে ভয় পাচ্ছি। সাত-আট বছরের মেয়েদের পর্যন্ত ভরসা করে স্কুলে পাঠাতে পারছি না।” গেদের ধর্ষিতা যে স্কুলে পড়ত, সেই ‘গেদে বিদ্যাসাগর মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র’-র শিক্ষিকা গায়ত্রী নাথ জানালেন, এই ঘটনার পর ছাত্রী অর্ধেক হয়ে গিয়েছে তাঁদের স্কুলে। অভিভাবকেরা পাঠাতে চাইছেন না।
মিছিলের মাঝামাঝি হাঁটছিলেন ঝর্ণা, বনি, রিনা-রা। বাড়ি রাজারহাট বিষ্ণুপুর। রিনা আর বনি রাজারহাট ডিরোজিও কলেজের ছাত্রী। ঝর্না ওই কলেজেরই সদ্য-প্রাক্তনী। কামদুনির ধর্ষিতা ওই কলেজেই পড়তেন।
হাঁটতে-হাঁটতে তিন জনই বললেন, “আমাদের কলেজের এলাকা এত খারাপ যে, বিকেল হতে না হতে বেরিয়ে পড়তে হয়। চার পাশে ফ্ল্যাট হচ্ছে। প্রচুর বাইরের ছেলেপিলে, মিস্ত্রিরা আসে। প্রচণ্ড বিরক্ত করে আমাদের। কামদুনির ঘটনা আমাদের কাঁপিয়ে দিয়েছে।” বলেন, “ভয় পাচ্ছি আমরা। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা চাইছি। হয়তো এর জন্য আমাদের মাওবাদী বলা হবে। তা-ও এই রকম মিছিল আবার হলে, আবার আসব।”

—নিজস্ব চিত্র
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.