|
|
|
|
প্রতিবাদী স্বরের পাশে রইল রাজনীতির মুখও |
ঋজু বসু |
ঠিক পাঁচ বছর সাত মাস সাত দিনের ব্যবধান। ফের একটি নাগরিক মিছিলে সরগরম মহানগর।
২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর। তদানীন্তন বাম জমানায় নন্দীগ্রাম ‘পুনর্দখল অভিযানে’র পরেই সে বার সমাজের বিশিষ্ট জনেদের ডাকে পথে নেমেছিলেন অজস্র নাগরিক।
২০১৩-র ২১ জুন। এ বার ক্ষোভ উস্কে দিয়েছে কামদুনিতে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। এই ‘অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগঠিত সামাজিক প্রতিরোধ গড়া’র ডাক দিয়েছিলেন কয়েক জন বিশিষ্ট নাগরিকই। সে বারের মিছিলের পুরোভাগে যিনি হেঁটেছিলেন, এ দিনের মিছিলেও সেই শঙ্খ ঘোষকে আগাগোড়া হাঁটতে দেখা গিয়েছে। তিনি অবশ্য দু’টি মিছিলের তুলনা করতে চাননি। তাঁর কথায়, “সে বারও একটা সর্বনাশা ঘটনার পরেই আমরা পথে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দু’টো উপলক্ষ আলাদা। তবু অল্প সময়ের মধ্যে খবর পেয়ে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে এত লোক চলে আসবেন, ভাবিনি!” |
|
আমারও কিছু প্রশ্ন আছে। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে বড়দের সঙ্গে পা
মিলিয়েছে এই খুদেও। শুক্রবার কলকাতার পথে। ছবি: সুমন বল্লভ |
এ বারে লক্ষণীয় ভাবে চোখে পড়েছে মিছিলে মেয়েদের উপস্থিতি। কামদুনির মেয়েটি যে কলেজে পড়তেন সেই ডিরোজিও কলেজের তরুণী পড়ুয়া থেকে শুরু করে কলকাতার যাদবপুর-প্রেসিডেন্সির ছাত্রী, শহুরে সম্পন্ন ঘরের মহিলা থেকে পাড়া-গাঁয়ের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যারা অনেকেই কলকাতার রাজপথে প্রতিবাদের শরিক হয়েছেন। মাঝবয়সী কর্মরতা থেকে সংসারী প্রৌঢ়া, কেউ মা, কেউ বা মেয়ে হিসেবে মিছিলে হেঁটেছেন।
কারও কারও মতে, গত এক বছরে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারী-নিগ্রহের বাড়বাড়ন্তে মেয়েরা অনেকেই যে ভাবে বিক্ষোভ দেখাতে পথে নেমেছেন, এ দিনের মিছিলেও তারই একটা প্রতিফলন মিলেছে। নির্ভয়া-র ঘটনার পরে এ শহরে যে মুখগুলিকে পথে নামতে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের অনেককেই এ দিনও রাজপথে দেখা গিয়েছে। শুধু কামদুনি নয়, প্রতিবাদের ভাষায় নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর বা রাজ্যের বাইরে গুজরাত-মণিপুর-ছত্তীসগঢ়ের নানা ঘটনাও এক বন্ধনীতে ধরা পড়েছে। স্লোগান উঠেছে, ‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-কামদুনি/সব শাসকের এক বাণী’। রূপান্তরকামী নারী, ফ্যাশন ডিজাইনার রায়না রায়ের হাতে পোস্টার, ‘বন্ধ করে সবার মুখ, স্বৈরাচারের তাতেই সুখ।’
তবে নন্দীগ্রাম-পরবর্তী সেই মিছিলের সঙ্গে তুলনায় ধারে-ভারে ও দৈর্ঘ্যে শুক্রবারের মিছিল কিছুটা পিছিয়ে ছিল বলে মনে করছেন বেশির ভাগ মানুষ। অনেকেই বলছেন, নন্দীগ্রাম বড় বিষয় ছিল, তাই মিছিলও ছিল বড়। এ বারের বিষয়টির ব্যাপকতা তুলনায় কম বলে মিছিল হয়তো ছোট। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এখানেও অনেকে এসেছেন। তবে সে বার চেনা রাজনৈতিক মুখগুলিকে সামনে দেখা যায়নি। এ দিনের মিছিলে ঘোষিত তৃণমূল-বিরোধী ও বামপন্থী নেতাদের কয়েক জনকে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছে। আয়োজকদের অনেকেরই দাবি, নন্দীগ্রাম-পরবর্তী মিছিলটিতেও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক শাখা-সংগঠন ও গণসংগঠনের কর্মীরা পতাকা ছাড়া হাঁটেন। কিন্তু কারও কারও পর্যবেক্ষণ, এ দিনের মিছিলে সেই প্রবণতা তুলনায় বেশি প্রকট মনে হয়েছে। |
প্রতিবাদের মুখ
|
শুক্রবার মিছিলে। ছবি: সন্দীপন চক্রবর্তী |
সে বার তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিছিলে যোগ দিতে চেয়েও আয়োজকদের অনুরোধে পিছিয়ে আসেন। এ দিনের মিছিলে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র সিপিএমের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, কংগ্রেস নেতা নির্বেদ রায় বা অসীম চট্টোপাধ্যায়কে হাঁটতে দেখে কারও কারও মন্তব্য, “এমনটা না-হলেই ভাল ছিল!”
কিন্তু রাজনৈতিক মুখ কি নাগরিক সমাজের অংশ নন, সে প্রশ্নও উঠেছে। ঘোষিত সিপিএম-সমর্থক, অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেন, “আমিও তো গণতন্ত্রের অংশ! তা হলে আমি কেন মিছিলে আসতে পারব না!” তাঁর মতো অনেকেরই বক্তব্য, রাজনৈতিক পরিচিতি থাকলেও এমন মিছিলে অনেকে ব্যক্তি-পরিচয় বহন করেই আসেন। তবে দলের ভাবনার সঙ্গে তাঁদের পদক্ষেপ মিলে যায় বলে তাঁরা বাড়তি জোর পান। আর এক দল অবশ্য বলছেন, নন্দীগ্রাম-পরবর্তী সময় থেকে এ রাজ্যের সংস্কৃতি জগতে যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল, তার ছাপ থেকে এ দিনের মিছিল বেরিয়ে আসতে পারেনি। বরং বিভাজনের চেহারাটা যে এখন আরও জটিল, সেটাই স্পষ্ট হয়েছে। মিছিল শেষে ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলের ছবিও তাই বুঝিয়ে দিয়েছে।
সাড়ে পাঁচ বছর আগের মিছিলটি ধর্মতলায় পৌঁছনোর পরে একটি মঞ্চ ঘিরেই একজোট হয়েছিল। এ বার ধর্মতলার মোড়ে কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে দু’টি ম্যাটাডর। একটিতে প্রধানত গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির সদস্যরা।
অন্যটিতে সিপিএম-ঘনিষ্ঠ কয়েক জন শিক্ষক-শিল্পীর ভিড়। বাম-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তরুণ মজুমদার দ্বিতীয় ম্যাটাডরটি থেকেই মাত্র দু’বছরের মধ্যে বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা খুইয়ে ফেলার কথা বললেন। বাম সরকারের কড়া সমালোচক প্রাক্তন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়ও (যিনি এক বার মমতার টিকিটে ভোটেও লড়েন) সিপিএম-ঘনিষ্ঠদের ম্যাটাডর থেকেই বক্তৃতা দিলেন। নাট্যকর্মী সুমন মুখোপাধ্যায় উঠে দাঁড়ান অন্য ম্যাটাডরে। একসঙ্গে দু’টি ম্যাটাডর থেকেই মাইক হাতে বক্তৃতা চলতে থাকায় মিছিলে যোগ দিতে আসা কেউ কেউ ঈষৎ বিরক্ত। “আরে বাবা, কার কথা শুনব! কোনওটাই ভাল ভাবে বোঝা যাচ্ছে না!”
এ দিন মিছিল শুরুর আগেই স্লোগানের রকমফের দেখে পারস্পরিক মতান্তরের একটা আভাস বোঝা যাচ্ছিল। কলেজ স্কোয়ারে মিছিলের সূচনায় শঙ্খবাবু কাউকে কোনও স্লোগান না-দিয়ে মৌনী-মিছিলে হাঁটতে বলেছিলেন। তাঁর সেই অনুরোধ সব সময় রক্ষিত হয়নি। মিছিল চলতে চলতে কেউ কেউ ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গান ধরেছেন। কারও স্লোগানে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ বা ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’-এর মতো চেনা রাজনৈতিক বুলিও উঠে এসেছে। স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে অনেক সময়েই এমন ঘটে থাকে বলে বিষয়টাকে তত আমল দিতে নারাজ মিছিলের আয়োজকদের একাংশ। কিন্তু অস্বস্তির একটা কাঁটা থেকেই যাচ্ছে মিছিলের এক আহ্বায়কের মন্তব্যে। আয়োজকরা বরং সেটা নিয়ে কিছুটা আহত। |
|
মিছিলে শঙ্খ ঘোষ।—নিজস্ব চিত্র |
নন্দীগ্রাম-পর্বের সময় থেকেই তদানীন্তন বাম সরকারের কট্টর বিরোধী তরুণ সান্যাল এ বারের মিছিলের বিবৃতিতে সই করেছিলেন। তখন তাঁর বক্তব্য ছিল, “বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রয়োজনে এমনটা হতেই পারে!” প্রবীণ তরুণবাবু মিছিলে আসেননি। পরে সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি কিছুটা ক্ষোভের সুরে বলেন, “সিপিএমের ছাত্র ও যুব সংগঠনের ছেলেরা অনেককে সংগঠিত করে মিছিলে নিয়ে এসেছেন।” আয়োজকদের একাংশের মতে, এ ভাবে বলে তরুণবাবু মিছিলটাকেই অপমান করেছেন। আবারও এটাও ঘটনা যে, মিছিল থেকে রাজ্যের বিরোধী শিবির রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করবে এই আশঙ্কাই থেকে অনেক বিশিষ্ট এ দিন পথে নামেননি। যেমন, অপর্ণা সেন নিজে জানিয়েছিলেন, তিনি মিছিলে আসবেন। কিন্তু তিনি আগের দিন কলেজ স্কোয়ারে অন্য একটি প্রতিবাদসভায় যোগ দেন। এ দিন তিনি মিছিলে ছিলেন না।
অনেকে আবার যাবতীয় আশঙ্কা-সন্দেহ দূরে রেখে প্রতিবাদটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন নাট্যকর্মী সুমন মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “কেউ কেউ বলতে পারেন, নন্দীগ্রামের মিছিলেও কারও কারও রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল। এখানেও সেটা থাকতে পারে। আমি এসেছি, আমার প্রতিবাদটা করতে।” সুমন ছাড়াও সমরেশ মজুমদার বা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত দু’টি নাগরিক মিছিলেই উপস্থিত ছিলেন। পুরোটা হাঁটার পরে সমরেশের বক্তব্য, “কামদুনির এই ছেলেরা যাঁরা মহাকরণে গিয়ে চাকরি-টাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন, তাঁরাই আমায় পথে নামতে প্রেরণা জুগিয়েছেন। শুধু ধর্ষণের ঘটনা নয়। কামদুনিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর রাগ, প্রতিবাদীদের মাওবাদী বলে দেগে দেওয়া আমার ভাল লাগেনি।” বস্তুত কামদুনির ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রীর নানা বিতর্কিত মন্তব্য যে এ দিন বহু মানুষকে আলাদা করে মিছিলে টেনে এনেছে, সেটা অনেকেই স্বীকার করছেন। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর লেখা নাট্যসংলাপ, ‘কামাওবাদী হওয়ার থেকে মাওবাদী হওয়া ভাল’ লেখা পোস্টারে সেই প্রতিবাদের ছাপ স্পষ্ট।
কামদুনির বাসিন্দারাও অনেকেই এ দিন মিছিলে সামিল হয়েছিলেন। এসেছিলেন গেদে ও গাইঘাটার নিহত নাবালিকাদের পরিচিত ও পরিজনেরাও। সুটিয়ার খুন হওয়া প্রতিবাদী যুবক বরুণ বিশ্বাসের দিদি প্রমীলা রায় ও বরুণের গড়ে তোলা নাগরিক-মঞ্চের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। দল-বহির্ভূত এই ভিড় দেখেই সিপিএমের গৌতম দেব বলেছেন, “মিছিলে শুধু সিপিএমের লোক ছিল না। সাধারণ ভাবে সিপিএমের মিছিলে হাঁটতে অস্বস্তিতে ভুগতেন এমন অনেকেই এই নাগরিক মিছিলে হেঁটেছেন মনে হল।” ৯১ বছরের মৃণাল সেন তাঁর শরীরের কারণে আসতে না-পারলেও একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। প্রবীণ অশোক মিত্র মিছিল শুরুর সময়ে ছিলেন।
অন্যতম আহ্বায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কিছু ক্ষণের জন্য মিছিলে হাঁটেন। মহাশ্বেতা দেবীও মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন। পরে তাঁর সঙ্গে আয়োজকদের ‘যোগাযোগ’ হয়নি বলে জানা গিয়েছে।
তবে একদা পরিবর্তনের পক্ষে সওয়াল করা যে বিশিষ্ট জনেরা মিছিলে হেঁটেছেন, তাঁদের এ দিন একহাত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন অন্ডালের উখড়ায় এক জনসভায় তিনি বলেন, “আমাদের একটা-দু’টো মিটিংয়ে এসেছিল। এখন ওরা দাবি করছে, ওরাই পরিবর্তন এনেছে। এ-ও বলছে, এই পরিবর্তন নাকি চায়নি। মরিচঝাঁপি, বানতলা, মেমারি থেকে নন্দীগ্রাম ৩৪ বছরে অনেক কাণ্ড হয়েছে। সেই সময়ে যাদের দেখা যায়নি, তারা এখন একজোট হয়ে প্রতিবাদে গলা ফাটাচ্ছে।”
পরিবর্তনপন্থী বলে পরিচিতদের অনেকেই অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। সুমন মুখোপাধ্যায়দের মতো কেউ কেউ বলেছেন, “কোনও সন্দেহ নেই, ৩৪ বছরের অপশাসনের পরে নতুন সরকারের পক্ষে কাজটা খুবই কঠিন। কিন্তু দু’বছর বাদেই এদের গলায় তো সিপিএমেরই স্বর শুনছি! যে কোনও প্রতিবাদকে মাওবাদী বা ষড়যন্ত্রকারী বলে খেলো করার চেষ্টা সেটা মেনে নেওয়া যায় না।”
|
পুরনো খবর: বিভাজন রেখেই আজ পথে বিশিষ্টরা |
|
|
|
|
|