যুগ্ম শত্রুর মহড়া আর
ভবিষ্যতের প্রাসাদ গড়ায় মগ্ন ধোনি
ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে ঘটুক। অব্যর্থ ইমেজারি হল, লর্ডসে অনেকটা পিছনে দৌড়ে ভিভের ক্যাচ ধরছেন কপিল দেব!
ভারত-শ্রীলঙ্কা ওয়ান ডে মানেও একটাই ইমেজারি! ওয়াংখেড়ের সেই জাদুগরি রাত্তিরে জয়সূচক ছক্কাটা হাঁকিয়ে নির্বিকার ব্যাট ঘোরাচ্ছেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি!
বুধবার ভারত অধিনায়কের সাংবাদিক সম্মেলন কভার করে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল, ওয়াংখেড়ের ছক্কাটা কার্ডিফে ফের মারার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। তফাতের মধ্যে, সে বার একটাই টিমের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। এ বার প্রকাশ্যে শ্রীলঙ্কা এবং ভারতীয় মিডিয়া যুগ্ম প্রতিপক্ষ তাঁর। আর তা নিয়ে এতটুকু বিচলিত নন।
ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে কখনও টিমের সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্কে এমন সর্বগ্রাসী বিভাজন দেখা যায়নি। প্রশাসনিক ম্যানেজার রঞ্জীব বিসওয়াল এ দিন ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, “ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডের ভয়ে আমরা টিমকে এত দূরে দূরে রাখতে বাধ্য হয়েছি। পাপারাৎজিদের কোনও বিশ্বাস নেই। কোথা থেকে ছবি তুলে নেবে। কোথায় কোন ফোনের কথাবার্তা ট্যাপ করে ফেলবে। আর ইন্ডিয়ার পিছনে লাগার জন্য এরা তো সব সময় তৈরিই থাকে।”
তাতে অবশ্যই এই প্রবণতাটা বিশ্লেষিত হচ্ছে না যে, দেশজ মিডিয়াকেও কেন এমন এড়িয়ে যাচ্ছে টিম। বিরাট কোহলির সঙ্গে খুব আলাপ এমন এক অবাঙালি ক্রিকেট প্রতিনিধি বলছিলেন, “আরে এ তো অদ্ভুত অবস্থা। বিরাট আই কনট্যাক্ট অবধি এড়িয়ে যাচ্ছে।” একা বিরাট বললে ভুল হবে! বাকিরাও! ভয় আর সন্দেহ, পাছে কথা বলা নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়ে যায়।

মিশন শ্রীলঙ্কা। প্র্যাক্টিসে ধবন, কার্তিক। বুধবার কার্ডিফে। ছবি: সৌমিত্র বসু।
স্বয়ং অধিনায়ক তো যে ভঙ্গিতে এ দিনও প্রেস কনফারেন্স করলেন, তাতে সোফিয়া গার্ডেন মাঠের কাচের প্রেসবক্সে যদি বুধবার তাঁর একটা ছক্কা এসে লাগে, উল্লসিতই হবেন। তীব্র ব্যঙ্গের সঙ্গে বললেন, “আপনারাই টুর্নামেন্টের আগে বলেছেন আমাদের ওপর কোনও আস্থা নেই। আপনারাই আবার এখন বলছেন, আমাদের নিয়েই সব আশা। আমরা অবশ্য দুটোর কোনওটাতেই না ঢুকে, ভাল খেলার প্রস্তুতি নিয়ে গেছি।” সম্মেলন থেকে বেরিয়ে মিডিয়ার গরিষ্ঠ অংশের স্বগতোক্তি শুনলাম: চ্যাম্পিয়ন হলে যে কী করবে!
সোফিয়া গার্ডেন মাঠটা কিন্তু হানাহানি বা রক্তপাতের আদর্শ লোকেশন একেবারেই নয়। বরঞ্চ ভেঙে যাওয়া বন্ধুত্ব, ভেঙে যাওয়া প্রেম-টেম জোড়া দেওয়ার দারুণ উপযুক্ত। কার্ডিফ শহরটাও এমনিতে খুব ছোট আর বন্ধুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর আর কোনও শহরে সিটি সেন্টারের দু’মাইলের মধ্যে তিনটে স্টেডিয়াম নেই। একটা অত্যাধুনিক মিলেনিয়াম স্টেডিয়াম। রাগবির। একটা কার্ডিফ সিটি স্টেডিয়াম। ফুটবলের। আর এই সোফিয়া গার্ডেন। গ্ল্যামরগান কাউন্টি ও ক্রিকেটের।
সোফিয়া গার্ডেনের বৈশিষ্ট্য অ্যাডিলেড ওভালের ঠিক বিপরীত। সাইড বাউন্ডারি বড় আর লম্বায় ছোট। বিবেকানন্দ পার্কে সম্বরণ অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থী যে স্ট্রেট ড্রাইভে চার পাবে, এখানে শিখর ধবনও তাই। পরিবেশের মাদকতায় অবশ্য কোনও তুলনাই হয় না। কার্ডিফেরটা ডিজাইনার স্টেডিয়াম। জায়গায় জায়গায় নীল, হলুদ, হালকা লাল। গ্যালারিটা এক ঝলকে চোখ জুড়োনো। ঠিক পিছনেই ট্যাফ নদী। ইডেনে ক্লাবহাউসের উল্টো দিকে হাইকোর্ট না থেকে যদি গঙ্গা বয়ে যেত, তা হলে যা দাঁড়াত সেটাই হল সোফিয়া গার্ডেন। মাঠটা নবীন হলেও গ্ল্যামরগান কাউন্টি তো আর নতুন নয়। সিধুজ্যাঠারা তাই আশেপাশেই রয়েছেন। তাঁদেরই একজন হিসেব দিলেন, ট্যাফ নদীতে জোয়ারের সময় নাকি বল সুইং করে বেশি।
ক্রিকেট পর্যটকের অবশ্য মাঠটায় ঢুকলে সুইং, ব্যাট, বল এগুলো প্রথম মনেই আসবে না। পাশে একটা ছোট মাঠ হকির গোলপোস্ট দেখলাম। ওখানে একটা টলটলে পুকুর থাকলে অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘মধ্যাহ্ন’ কবিতাটা আরও উপযোগী হত।
...এবেলা জগৎ ভুলে পড়ে আছি নদীকূলে
পড়েছে নধর বট হেলে ভাঙা তীরে
ঝুরুঝুরু পাতাগুলি কাঁপিছে সমীরে...

প্র্যাক্টিসে কোহলি। ছবি: সৌমিত্র বসু।
গাছগাছালিতে ভরা শান্ত, সৌম্য স্টেডিয়াম। যাকে ঘিরে রেখেছে ওক, পাম আর চেরি গাছ। আর এক রকম গাছ দেখলাম, সরু সরু পাতা। এরা বলল, মাউন্টেন অ্যাশ।
মাউন্টেন অ্যাশ-এর বাংলা খুঁজে পাচ্ছি না, কিন্তু ক্রিকেটীয় অ্যাশের বাংলা স্বচ্ছন্দে করা যায়। ক্রিকেটের চিতাভস্ম। আরও নিখুঁত করে বললে, দু’হাজার এগারো, দোসরা এপ্রিল রাতের চিতাভস্ম! তার পর আরও দশ বার ওয়ান ডে খেলেছে দু’দেশ। কিন্তু এমন সম্মাননীয় কোনও মঞ্চে মুখোমুখি হয়নি যেখানে ভস্মাধারটা অদৃশ্য ভাবে মাঠের এক কোণে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের প্রাপ্য আই ফর্টি হুন্ডাই এসইউভি-র মতো রাখা রয়েছে।
গাড়িটার অন্যতম দাবিদার এরই মধ্যে শিখর ধবন! টুর্নামেন্টে ২৬৪ রান করে বসে রয়েছেন। ব্রিটিশ মিডিয়ার অনন্ত কৌতূহল এখন ধবন নিয়ে। প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার যাঁর পা-ও ট্যাটু করানো। সেই ছবি তুলছিল এ দিন স্কাই টিভি। ধবন তখন ফিল্ডিং কোচ ট্রেভর পেনি-র দেওয়া চল্লিশ গজি উঁচু ক্যাচ ধরার অনুশীলন করে যাচ্ছেন। একটা বল ধরতে গিয়ে তো ইনস্টেডিয়া ছোট বিলবোর্ড টপকে পড়ে গেলেন ভেতরে। আঁতকে ছুটে এল সবাই, লাগেনি তো! টিমে সহবাগীয় মর্যাদা এই ক’দিনেই ধবনকে ঘিরে।
এত রোদ্দুর এ দিন আর মাঠের ধার যেহেতু ছাউনিবিহীন, সানস্ক্রিন লোশন ছাড়া কেউ ভরসা পাচ্ছিলেন না আগাগোড়া কাছ থেকে টিম ইন্ডিয়া-র প্র্যাক্টিস দেখার। ব্রিটিশ বসন্তে বুধবার কার্ডিফে প্রথম এমন চড়চড়ে নীল আকাশ। স্থানীয়দের ভাষায় “গর্জাস ওয়েদার।” কিন্তু দুঃখের সঙ্গে তাঁরা এটাও বলে দিচ্ছেন, “কাল তো বৃষ্টি। ওয়েদার রিপোর্ট বলছে ম্যাচই হবে না বোধহয়।” বিদেশি সাংবাদিকেরা বারবার চড়চড়ে নীল আকাশের তলাতেই আলোচনা করে গেলেন, খেলা না হলে সুপার ওভার করার চেষ্টা হবে। দুটো দল এক ওভার করে। সেটাও সম্ভব না হলে গ্রুপ শীর্ষে থাকার সুবিধেয় ভারত ওভাল ফাইনালে চলে যাবে। হাওয়া অফিসের রিপোর্ট আসলে এখানে বেদবাক্য। তাই বুধবার যা দেখছি, আসলে বৃহস্পতিবার নাকি সেটা দেখছি না!

তিনি শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের নির্বাচক কমিটির প্রধান। সেই সনৎ জয়সূর্য বুধবার
কার্ডিফে এসেছিলেন নিছক টিমকে উৎসাহ দিতে নয়। আলাদা করে অনেকটা
সময় প্র্যাক্টিস করালেন মালিঙ্গা-কুলশেখরাকেও। ছবি: দেবাশিষ সেন।
ম্যাচেও কি তাই? বুধবার ভারতের যে ফিল্ডাররা চল্লিশ-পঞ্চাশ গজি উঁচু থ্রো-তে লাফাচ্ছিল ঝাঁপাচ্ছিল, তাদের মধ্যে রায়না ছাড়া সবই তো নতুন মুখ। ধবন, জাডেজা, দীনেশ, ভুবনেশ, উমেশ...। দোসরা এপ্রিলের রাত্তির থেকে ‘কমন’ মুখ মাত্র তিন জন। ধোনি, কোহলি, রায়না। শ্রীলঙ্কা টিমেও একই অবস্থা। কমন ছ’জন। মাত্র দু’বছরেই দুটো টিম এত বদলেছে!
গত দশ সাক্ষাতের সত্তর ভাগ ম্যাচ ভারত জিতেছে, তা দিয়ে একেবারেই নতুন সমীকরণকে ধরা যাবে না। দুটো টিমই আসলে ‘ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস’। মাল্টিস্টোরিড তৈরির সময় যেমন স্টিল, সিমেন্ট, চুন, বালি, ইট, টাইলস, ইলেকট্রিকের কাজ, প্লাম্বিংয়ের কাজ সব একসঙ্গে লাগে। তেমনই দ্রুততর ফিল্ডার, অপেক্ষাকৃত ফিট বোলার, দ্রুতগামী ব্যাটসম্যান নিয়ে তৈরি হচ্ছে দুটো টিম। অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৫ বিশ্বকাপ মাথায় রেখে।
ডিজাইনার স্টেডিয়ামে তাই এমন দুটো টিমের সাক্ষাৎ হচ্ছে যাদের উত্তরাধিকার দোসরা এপ্রিলের রাতের বললে ঠিক বলা হয় না। বরঞ্চ তারা যার যার মতো করে ভবিষ্যতের ডিজাইনার প্রাসাদ হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।
সোফিয়া গার্ডেনেরটা ভারা-বাঁধা থাকতে থাকতে, মিস্ত্রিরা কাজ করার সময় একটা টেস্টিং কোন বাড়িটা বেশি মজবুত হয়ে তৈরি হচ্ছে?


বিলেতে ভারত-শ্রীলঙ্কা
ম্যাচ-৫
শ্রীলঙ্কা জয়ী ১
১৬ জুন, ১৯৭৯, ম্যাঞ্চেস্টার, বিশ্বকাপ
শ্রীলঙ্কা- ২৩৮-৫, ভারত- ১৯১
দলীপ মেন্ডিস (৬৪)
শ্রীলঙ্কা ৪৭ রানে জয়ী
২৬ মে, ১৯৯৯, টনটন, বিশ্বকাপ
ভারত ৩৭৩-৬,শ্রীলঙ্কা ২১৬
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৩)
ভারত ১৫৭ রানে জয়ী
৩০ জুন, ২০০২, ওভাল, ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ
শ্রীলঙ্কা ২০২-৮, ভারত ২০৩-৬
অজিত আগরকর (৩-৪৪)
ভারত ৪ উইকেটে জয়ী
৬ জুলাই, ২০০২, এজবাস্টন, ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ
শ্রীলঙ্কা- ১৮৭, ভারত- ১৮৮-৬
রাহুল দ্রাবিড় (৬৪)
ভারত চার উইকেটে জয়ী
১১ জুলাই, ২০০২, ব্রিস্টল, ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ
ভারত- ৩০৪, শ্রীলঙ্কা- ২৪১
সচিন তেন্ডুলকর (১১৩)
ভারত ৬৩ রানে জয়ী




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.