প্রশ্ন করা এবং অনাস্থা জ্ঞাপনের মধ্যে ফারাকটি চোখ এড়াইয়া যাওয়ার মতো ক্ষীণ নহে। তবু, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ফারাক ভুলিয়াছেন বলিয়া সংশয় হয়। শিলাদিত্য চৌধুরী তাঁহাকে প্রশ্ন করিয়াছিলেন। তিনি শিলাদিত্যকে ‘মাওবাদী’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়া দেন। এক টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে জনাকয়েক ছাত্রছাত্রী তাঁহাকে কিছু প্রশ্ন করে। তিনি তাহাদেরও ‘সিপিএম/মাওবাদী’ বলেন। সম্প্রতি কামদুনির স্থানীয় মহিলারা তাঁহাকে কিছু কথা বলিতে চাহিলে তিনি তাঁহাদেরও ‘চোপ’ বলিয়া থামাইয়া ‘সিপিএম’ হিসাবে দাগিয়া দেন। দুর্ভাগ্য, মুখ্যমন্ত্রী কেবল অপ্রীতিকর প্রশ্নগুলিই শুনিয়াছেন, সেই প্রশ্নের সহিত লগ্ন ‘দিদি’ ডাকটি তাঁহার শ্রুতিগোচর হয় নাই। কেহ তাঁহাকে প্রশ্ন করিতেছেন বলিয়াই যে তিনি বিরোধী পক্ষ, তাঁহাকে হেনস্থা করিবার উদ্দেশ্যেই মুখ খুলিতেছেন, এ কথা ভাবিবার কারণ নাই। মানুষের নিকট সরকার এখনও সর্বোত্তম অভিভাবক। আর, মুখ্যমন্ত্রী হইবার পূর্বে এই মমতাদেবীই মানুষের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া, পরম স্নেহে তাঁহাদের অবস্থার কথা শুনিতেন। আজকের এই অসহিষ্ণুতা কি শুধুমাত্র মহাকরণের সর্বোচ্চ কুর্সিটির কল্যাণেই? দ্বিতীয় কথা, প্রশ্নকর্তা যদি সত্যই কট্টরতম সিপিএম সমর্থকও হন, তাঁহার কথা শোনা, তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, কেবলমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের নহেন। বিরোধী নেত্রী তাঁহার সমর্থকদের, মুখ্যমন্ত্রী সকলের।
বিরোধী নেত্রী রূপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। রাজনীতির স্রোতে তাঁহার অবস্থানটি বদলাইয়াছে বটে, কিন্তু মন সম্ভবত বদলায় নাই। মনেপ্রাণে তিনি এখনও বিরোধী নেত্রীই আছেন। ফিদেল কাস্ত্রোর কথা মনে পড়িতে পারে। তিনি সম্ভবত বিশ্বাসই করিতে পারেন নাই যে যুদ্ধ শেষ হইয়াছে এবং তিনি প্রশ্নাতীত ভাবে জয়ী। তিনি লড়াই অব্যাহত রাখিয়াছিলেন। সে লড়াই শেষ অবধি আত্মঘাতী হইয়াছিল, কিউবার সম্ভাবনা এবং বাস্তবের বিপুল দূরত্ব দেখিলে সেই আত্মঘাতের ব্যাপ্তি এবং গভীরতা বোঝা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর লড়াই তাহা অপেক্ষাও করুণ। বিরোধিতার জন্য প্রতিপক্ষ প্রয়োজন। যত দিন সিপিএম ক্ষমতায় ছিল, তত দিন সমস্যা হয় নাই। কিন্তু এখন? মুখ্যমন্ত্রী অতএব প্রতিপক্ষ গড়িয়া তাহাকে দোষারোপ করিতে ব্যস্ত। কামদুনিতেই যেমন হইল। যে মহিলারা তাঁহার নিকট ক্ষোভ প্রকাশ করিতেছিলেন, তাঁহাদের ক্ষোভের অভিমুখ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দিকে ছিল না। তাঁহাদের ক্ষোভ ছিল পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে। সেই ক্ষোভ বামফ্রন্ট জমানা হইতেই জমিয়া উঠিয়াছে। বারাসত অঞ্চলে গত কয়েক বৎসরে অব্যবস্থা যে মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে, তাহাতে এই ক্ষোভ স্বাভাবিক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী, তাঁহার বিরোধী-সত্তার প্ররোচনায়, সিপিএম-তৃণমূল দ্বন্দ্ব টানিয়া আনিলেন। নাগরিক সমাজে প্রশাসনিক অব্যবস্থা লইয়া যে তর্ক হওয়া উচিত ছিল, তাহা ঘুরিয়া গেল রাজনীতির দিকে। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের পরেও মুখ্যমন্ত্রী এই কাজটিই করিয়াছিলেন। ইহাতে পশ্চিমবঙ্গ সঙ্কীর্ণ রাজনীতির ঘোলা জলে ডুবিতেছে। পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক যে কোনও আলোচনার মূল সুর এই রাজ্যের প্রশাসনহীনতা। যাঁহারা বিরোধী, তাঁহারা বলিবেন এই রাজ্য হইতে প্রশাসন সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হইয়াছে। আর, শাসকদলের নেতা-সমর্থকরা সেই দাবি নস্যাৎ করিবেন, অথবা তাহাকে পূর্বসূরিদের চাপাইয়া দেওয়া বোঝা বলিয়া দায় সারিতে চেষ্টা করিবেন। কিন্তু, বারাসত হইতে গাইঘাটা, মালদহ কলেজ হইতে হলদিয়া বন্দর প্রশাসনহীনতাই এই রাজ্যের ধ্রুবপদ। কী অসীম দুর্ভাগ্য! ভারতের দুই প্রান্তের দুইটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাম অধুনা জাতীয় সংবাদের শিরোনামে। তাহার কারণ যাহাই হউক, এই দুই মুখ্যমন্ত্রীর নামের সঙ্গেই উন্নয়নের প্রশ্নটি গভীর ভাবে জড়িত। এমনকী যাঁহারা তাঁহাদের বিরোধী, তাঁহাদের বিরোধিতাতেও এই দুই নেতার উন্নয়নের মডেল সম্যক আলোচনার অন্যতম বিষয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে পশ্চিমবঙ্গও সেই তর্কের স্বাদ পাইয়াছিল কৃষি বনাম শিল্প, গ্রাম বনাম শহর তর্ক যে পথেই যাউক, তাহা উন্নয়নের তর্ক ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাত্র দুই বৎসরেই উন্নয়ন হইতে বহু দূরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। বড় কম সময়ে এই রাজ্য বড় বেশি পিছাইয়া গেল। |