|
|
|
|
এ বার বাম-শূন্য ‘লেনিন নগরী’
সুব্রত গুহ • খেজুরি |
খেজুরির কামারদা। একদা বামদুর্গ। এলাকায় পরিচিত ছিল ‘লেনিন নগরী’ নামে। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে সর্বত্রই যখন তৃণমূলের জয়জয়কার, তখনও খেজুরি-১ ব্লকের এই পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনের ১৩টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল সিপিএম। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পর পরিস্থিতি এমনই যে, এ বার ১৩টি আসনের ১২টিতেই তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। একটি মাত্র আসনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এক জন। তিনি তৃণমূলেরই বিক্ষুব্ধ। এক কথায় খেজুরির রাজনীতি বলতে এখন শুধুই তৃণমূল। ভোটও হবে তৃণমূল বনাম বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের মধ্যে।
তাই দিঘা-কলকাতা সড়কপথের হেঁড়িয়া থেকে পূর্ব দিকে বিদ্যাপীঠ ছুঁয়ে বোগা পর্যন্ত চলে যাওয়া খেজুরি বিধানসভা কেন্দ্রের একমাত্র রাস্তার দু-ধারে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিশির-শুভেন্দু অধিকারীর বড় বড় কাট-আউট আর তৃণমূলের তেরঙ্গা পতাকা। দূরবীন দিয়েও লাল ঝান্ডা চোখে পড়ে না কোথাও।
এ বার ইতিমধ্যেই তৃণমূল খেজুরি-১ পঞ্চায়েত সমিতি ও ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের দখলে নিয়েছে। আসন হিসাবে ধরলে খেজুরির ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৮৩টি আসনের মধ্যে ১১৫টি ও ২টি পঞ্চায়েত সমিতির মোট ৩৩টি আসনের মধ্যে ১৬টিতে তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দেননি। অর্থাৎ মাত্র ৬৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১৭টি পঞ্চায়েত সমিতি আর ৪টি জেলা পরিষদ আসনে ভোট হবে। |
খেজুরির গ্রামে উড়ছে শুধু তৃণমূলের পতাকা।—নিজস্ব চিত্র। |
অথচ, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটেও খেজুরির ২টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ জেলা পরিষদের ৪টি আসনের মধ্যে ৩টি নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছিল বামেরা। কাঁথির প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ ও সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রশান্ত প্রধান বলেন, ‘‘লোকসভা নিবার্চনে তৃণমূল জিতে যাওয়ার পরেই আমাদের নেতা, কর্মীদের উপর ব্যাপক সন্ত্রাস শুরু করে। আমাদের প্রচুর লোকজন এখনও ঘরছাড়া। যাঁরা এ বার সাহস করে প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদেরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।” একই অভিযোগ কংগ্রেসেরও। জেলার পঞ্চায়েত ভোট করানোর দায়িত্বে থাকা প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর সাহুর অভিযোগ, ‘‘হলুদবাড়ি পঞ্চায়েতের চৌদ্দচুলী আসনে দলের মহিলা প্রার্থী কুহেলী প্রধান তৃণমূলের ভয়ে সপরিবারে তমলুকে জেলা কংগ্রেস অফিসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ গাড়ি করে তাঁকে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিলেও তিনি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।” কুহেলীদেবী নিজে বলেন, “ছেলেমেয়েকে বাড়িতে আনার সাহস পাচ্ছি না। রাতের বেলা তৃণমূলের বাইক বাহিনী এসে হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছে।”
যদিও খেজুরির তৃণমূল বিধায়ক রণজিৎ মণ্ডলের বক্তব্য, “খেজুরির মানুষই আর ওদের চায় না। প্রার্থী করার মতো লোক না পেয়ে বহিরাগত নেতারা সন্ত্রাস-সন্ত্রাস বলে চেঁচাচ্ছে।”
তাই বলে গোটা খেজুরিতে সিপিএম বা কংগ্রেসের একটা পতাকাও চোখে পড়বে না? সিপিএমের একটি কার্যালয়ও নেই। হেঁড়িয়াতে কংগ্রেসের একমাত্র অফিস একা কুম্ভের মতো সামলাচ্ছেন খেজুরি বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী কমিটির সভাপতি সোমশঙ্কর মণ্ডল। কামারদা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিএমের কৃষ্ণা দাস বলেন, “দলের কিছু ভুল সিদ্ধান্তেই খেজুরিতে আজ সিপিএমের এই দুরবস্থা। যার খেসারত দিতে হছে কর্মী-সমর্থকদের, যাঁরা আদৌ সেই সিদ্ধান্তের অংশীদার ছিল না। আমি এখনও দরকার পড়লে পঞ্চায়েত অফিসে যাই। দল বললে হয়তো এ বারও ভোটে দাঁড়াতাম। কিন্তু দলের কেউ যোগাযোগ করেনি।”
দলের জেলা নেতারা যে আর যোগাযোগ রাখেন না, এমনটা অনুযোগ করলেন এলাকার আরও কিছু ‘একনিষ্ঠ’ সিপিএম সমর্থক। সে কথা কার্যত মেনে নিয়ে প্রশান্তবাবু বলেন, “ওখানে নেতারা কেউ নেই। ফলে নিচুতলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আমরা খেজুরিটা ছেড়েই দিয়েছি।”
এ দিকে, বিরোধীশূন্য হয়েও তৃণমূল যে নিশ্চিন্তে আছে, এমনটা নয়। খেজুরির যে ৬৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে ভোট হবে, তাতে বামেদের মাত্র দু’জন প্রার্থী রয়েছেন। কংগ্রেসের ৮। পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রেও ১৭টি আসনের মধ্যে সিপিএম ও কংগ্রেস মাত্র ২টি করে আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছে। বাকি সব নির্দল প্রার্থী, যাঁদের অধিকাংশই তৃণমূলের আদির্পবে দলের সঙ্গে থাকলেও বতর্মানে দলের টিকিট না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। কামারদার একমাত্র যে আসনে ভোট হচ্ছে, সেই আমজাদনগরে তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বনাথ মালিকের বিরুদ্ধে তৃণমূলেরই এক বিক্ষুব্ধ প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। তৃণমূলের জেলা পরিষদ আসনের প্রার্থী পার্থপ্রতিম দাস বলেন, “মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকায় অনেক যোগ্য ব্যক্তিকেই প্রার্থী করা যায়নি। তাই বলে দলের বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ানি। যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা দলের কেউ নন।”
অন্য দিকে এ বার টিকিট না পেয়ে খেজুরির আশাভবন পার্টি অফিসে বসে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন গত পঞ্চায়েত ভোটে খেজুরি-১ পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূলের একমাত্র জয়ী প্রার্থী জগদীশ দাস। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএমের সন্ত্রাসের রাজত্বে একমাত্র জয়ী প্রার্থী আমি। অথচ এ বার আমাকেই প্রার্থীপদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কাঁথির সাংসদ শিশির অধিকারীর কাছে গিয়েও ফল হয়নি।” পার্টি অফিসে পাশে বসা তৃণমূল নেতা অমিতাভ দাস উত্তেজিত জগদীশবাবুকে বোঝাতে থাকেন, “দলের স্থানীয় নিচু তলার কর্মীরা আপনাকে চাননি। তাই অন্য জনকে প্রার্থী করা হয়েছে। এতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই।”
জগদীশবাবু চুপ করে গেলেও দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে নির্দল হিসাবে দাঁড়িয়েছেন অনেকে।
কিন্তু সিপিএমের লোকেরা নির্দল হিসাবে দাঁড়ানোরও সাহস পাননি। তাঁদের চোখমুখ দেখে একটা বিষয় পরিষ্কার, খেজুরির মানুষ এখনও মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাননি। পরিবর্তনের ঝড়ে দলতন্ত্র সরিয়ে গণতন্ত্র আসেনি। বরং দলতন্ত্রই আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে শুধু রঙের। |
|
|
|
|
|