|
|
|
|
স্টেশন আর বাসস্ট্যান্ডে জনসংযোগ সিপিএমের |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
‘‘গোপাল দা যে! কী খবর?’’ চা দোকান থেকে হাঁক শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন গোপাল দাস (পরিবর্তিত নাম)। হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে কুশল বিনিময়। এলাকার খবরাখবর লেনদেন।
সে সময় পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলেন আর এক চেনা মুখ। জব্বর আলি (পরিবর্তিত নাম)। তীরের বেগে ছুটে গেল কয়েকটি শব্দ, ‘কী জব্বর ভাই।’ হাত নেড়ে ইশারা। জব্বর আলি বুঝিয়ে দিলেন, তাঁদের মনে রেখেছেন। কিন্তু সিপিএম নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছে কেউ কেউ দেখে ফেললে গ্রামে ফিরে বিপদে পড়তে হতে পারে। তাই নিজের কাজে দ্রুত চলে গেলেন।
সিপিএম এখন এভাবেই জনসংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। অবশ্যই, এলাকায় গিয়ে নয়। শহরের বাসস্ট্যান্ডে, স্টেশনে, বাজারে। শুধু এটাই নয়, জনসংযোগের আরও একটি পদ্ধতি নিয়েছে সিপিএম। চেনা মুখ নয়, দলের তথাকথিত তাবড় নেতাও নয়, ছাত্র ও যুব নেতাদের পাঠাচ্ছে এলাকায় এলাকায়। যাঁদের সিপিএম বলে কেউ চেনে না। তাঁরাই গোপনে দলীয় কর্মীদের কাছে দলের কর্মসূচি জানিয়ে দিয়ে আসছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এভাবেই নিজেদের সংগঠনকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে সিপিএম। |
|
খড়্গপুরে ভোটপ্রচার |
২০১১ সালে রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই বেশিরভাগ এলাকায় সিপিএমের রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বেশিরভাগ আসনেই প্রার্থী দিতে পারেনি সিপিএম। অধিকাংশ নেতাই এলাকা ছাড়া। কেউ বা ‘ফেরার’। সাধারণ কিছু কর্মী এলাকায় রয়েছেন। বিশেষত, কেশপুর, গড়বেতা, চন্দ্রকোনা রোড, শালবনির মতো এলাকার নেতারা আদৌ কবে এলাকায় ফিরতে পারবেন তা নিয়ে দলে সংশয় রয়েছে। তা সত্ত্বেও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে কিছু আসনে প্রার্থী দিয়েছে সিপিএম। নিয়েছে প্রচারের অভিনব কৌশল।
কৌশলটা জেলার সদর মেদিনীপুর শহর কেন্দ্রিক। জেলাশাসকের অফিস, আদালত, মেদিনীপুর মহকুমাশাসকের অফিস, বাজার-ঘাট রয়েছে এখানে। বিভিন্ন এলাকার মানুষকে নিত্য প্রয়োজনে, প্রশাসনিক হোক বা বাজার করা, মেদিনীপুর শহরে আসতেই হয়। সব বাসই এসে দাঁড়ায় এলআইসি মোড়ে। যেখানে মেদিনীপুর শহরের যাত্রীদের বেশিরভাগই নেমে যায়। তাই এলআইসি মোড়ের চা-পানের দোকানই এখন জনসংযোগের ভরসা সিপিএমের। বাস থেকে পরিচিত মুখ নামছে দেখলেই হাসি মুখে কথা বলে নেওয়া। যাঁদের কথা বললে গ্রামে ফিরে সমস্যায় পড়তে হতে পারে তাঁদের সঙ্গে ইশারায় বুঝিয়ে দেওয়া, ‘আমরা আছি’। তুলনায় সাহসীরা অবশ্য এগিয়ে এসে কথা বলছেন। এলাকার খবরাখবর জানাচ্ছেন। এখন কোন এলাকায় কে তৃণমূলের নেতা হয়েছে, কোন নেতা স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন, কোন নেতার সঙ্গে ঠিকাদারের ঝামেলা হয়েছে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে কে কোথায় কবে কাদের হাতে মার খেয়েছে প্রভৃতি। মৃদু হেসে সিপিএম নেতার জবাব, “সবুর কর না। আমরা আছি তো।” পাশে থাকা অন্য নেতা তখন একটু উল্টো ভাবে জানালেন, “তোমরা কবে নিয়ে যাবে বল?” এ ভাবে কথার ফাঁকেই গুরুত্বপূর্ণ কথাও জানিয়ে দেওয়া দলীয় সমর্থকদের। কী ভাবে পঞ্চায়েতে যে ক’টা আসন দিয়েছে সেখানে ভোট করাতে হবে, যেখানে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে একাধিক প্রার্থী রয়েছে, সেখানে নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করতে হবে, বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, কিভাবে তাঁদের আস্থাভাজন হতে হবেযাবতীয় ‘টিপস্’। এক সিপিএম নেতার কথায়, “এ ছাড়া তো কোনও উপায় নেই। এলাকায় গেলেই তো মিথ্যে মামলা দিয়ে দেবে। জেল খাটিয়ে ছাড়বে। মানুষ একটা সময় ঠিক বুঝতে পারবে। সেই বোঝাটা ত্বরান্বিত করতেই এই কৌশল।”
এখন কেশপুর, গড়বেতা বা চন্দ্রকোনারোডের জোনাল কমিটির অফিসগুলি খোলা থাকলেও লোকাল কমিটির অফিসগুলি বন্ধই। জোনাল কমিটির অফিসেও নেতারা গিয়ে বৈঠক করেন না। এমনকী পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের সব আসনে প্রার্থী দিলেও এলাকায় গিয়ে প্রচারের পরিস্থিতি নেই। তবুও পঞ্চায়েত ভোটকে সামনে রেখেই পার্টির কাজ শুরু করতে চাইছেন সকলে। এখন নেতারা থাকছেন মেদিনীপুর শহরে। বৈঠক বা কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার জন্য জেলা কৃষকসভার অফিসে বসছেন। কখনও সিপিএমের মেদিনীপুর জোনাল কমিটির অফিসেও বসছেন। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, কে এলআইসি মোড়ে থাকবেন, কারা যাবেন বড়বাজারে, বাসস্ট্যাণ্ডে, আদালতে বা স্টেশনে। এলাকার পরিচিত মুখ দেখলেই, যেন হঠাৎ দেখা হল এমন ভাবে আলাপচারিতা শুরু করা ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে সিপিএমের এই জনসংযোগের কৌশল কতটা খাটে, সেটাই এখন দেখার।
|
|
|
|
|
|