|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
ঘুম ভাঙালেন মিস্টার ভুলু |
বানতলা, পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি...। তবু বিদ্বজ্জনেরা নিদ্রামগ্ন। নাট্যরঙ্গের
মিস্টার ভুলু সেই ঘটনাকেই তুলে আনল মঞ্চে। দেখে এলেন গৌতম চক্রবর্তী |
বারাসতের কামদুনি গ্রামই কলকাতার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহের শীতঘুম ভাঙিয়ে দিল!
প্রেক্ষাগৃহটি বাগবাজারের গিরিশ মঞ্চ। রবিবার, ৯ জুন রাতে তখন সদ্য শেষ হয়েছে স্বপন সেনগুপ্তের পরিচালনায় নাট্যরঙ্গের ‘মিস্টার ভুলু’। নাটকের নায়ক স্মরজিৎ ছা-পোষা কেরানি। কিছুই মনে থাকে না তার। অফিস থেকে ফেরার পথে চা-পাতা আনতে ভুলে যায়। মাছের ব্যাগ বাড়িতে ফেলেই বাজার চলে যায়।
এই ‘ভুলু’ স্মরজিৎই এক রাতে বাড়ি ফেরার পথে ব্রিজের নীচে এক ধর্ষণের ঘটনা দেখে ফেলে। কিন্তু স্ত্রী, পুত্র থেকে পুলিশ অফিসার, ডাক্তার, স্থানীয় কাউন্সিলর সকলেই তাকে বলে, ‘ওটা ভুলে যাও।’ শেষ অবধি ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিতে যান। আর ভুলু সাপের মতো বুকে হেঁটে ঘুরতে থাকে সারা মঞ্চ। ‘‘সরীসৃপেরা শীতকাল এলে চার মাস ঘুমোয়...তাই না ডক্টর? তাদের ঠান্ডা রক্ত গরম হয়ে ওঠে না কিছুতেই...ঘুমোতে ঘুমোতে তারা শপিং মলে বাজার করতে যায়, নাট্যোৎসবে নাটক দেখে, শীতঘুম কাটে না। চোখের ওপরে কতকগুলো কুকুর একটা মেয়েকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলল...শীতঘুম!”
স্মরজিতের ভূমিকায় সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগে ‘ডিরোজিও’ থেকে ‘শ্রীশম্ভু মিত্র’, ‘বিকেলে ভোরের সর্ষেফুল’ অবধি অনেক নাটকেই তিনি তাক লাগিয়েছেন। কিন্তু নিরীহ মধ্যবিত্তের চরিত্রে এই রকম অভিনয়হীন অভিনয়? বুকে হাঁটার ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং? সাধে কৌশিক সেন বলছিলেন, ‘‘সুরজিৎ এত শক্তিশালী, তবু আন্ডাররেটেড! এখনও ওর মূল্যায়ন হয়নি।”
ঘটনাচক্রে, মূল্যায়ন হয়ে গেল সে দিনের নাটকশেষে। অভিনেতা, পরিচালক সকলেই তখন মঞ্চে। হাততালি। তখনই দর্শকাসন থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জনা পাঁচেক মহিলা বলে উঠলেন, “ এ ভাবে নয়। চলুন, ওঁদের স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিই।” ফের সারা হল দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি। স্বতঃস্ফূর্ত এই ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ কত দিন বাদে দেখল বাংলা মঞ্চ? |
‘মিস্টার ভুলু’ নাটকের একটি দৃশ্য
|
নাটকের শক্তিমত্তা এখানেই। কারা মেয়েটিকে ধর্ষণ করল, তারা কোন দল ইত্যাদি অহেতুক বৃত্তান্ত নয়। বরং মধ্যবিত্ত জীবনের শীতঘুমকে ব্যঙ্গ। কিছু দিন তোলপাড়, বিবৃতি আর পাল্টা বিবৃতি। তার পর আপাত শান্তিকল্যাণ। এবং এক দিন ফের চমকে ওঠা। বানতলা, পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, দিল্লি, কামদুনি, গেদে। শঙ্খ ঘোষেরও ভাল লেগেছে নাটক, “প্রতিবাদ যে হয় না, তা নয়। কয়েক দিনের উত্তেজনা থাকে, তার পর থিতিয়ে যায়। কিন্তু প্রতিবাদ এক জিনিস, সামাজিক ভাবে প্রতিরোধ করার স্থায়ী আন্দোলন আর এক।”
সুরজিতের নাটক এই স্থায়ী প্রতিরোধের কথাই বলে। মধ্যবিত্ত ‘মিস্টার ভুলু’ সিনেমার মতো একাই ধর্ষণকারীদের পিটিয়ে ছাতু করে দেয় না। বিপ্লবীদের মতো ঝান্ডা তুলে মিছিল করে না। বরং শীতঘুমের ইঞ্জেকশন নেওয়ার পর শেষ দৃশ্যে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। অফিস থেকে ফেরার সময় চা পাতা আনতে আর ভোলেনি সে। ব্যাগ খুলে একটার পর একটা জিনিস স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়। ব্রিজের ঘটনাটাও ভোলেনি? সরাসরি উত্তর নেই। শক্ত চোয়ালের নীরবতাই সব বুঝিয়ে দেয়।
প্রতিবাদ? নাকি, সাম্প্রতিককে সম্বল করে মঞ্চসাফল্যের পারানি? নাট্যকার স্নেহাশিস ভট্টাচার্যের এটিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নাটক। ২০১১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ লেখা শেষ। অতঃপর দলে নাটক তৈরি হতে থাকে। আর তখনই কাকতালীয় ভাবে একের পর এক পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, দিল্লি। “এরকম যন্ত্রণাদায়ক ভাবে নাটকটা সত্যি হয়ে উঠুক, চাইনি,” বললেন নাট্যকার।
এই নাটক সময়ের প্রতিধ্বনি। ইঞ্জেকশন দিতে-আসা ডাক্তারকে ভুলু জিজ্ঞেস করে, ‘আমি যদি সব কিছু ভুলে থাকি, তা হলে রাতবিরেতে কতকগুলি শকুনের বাচ্চা কচি মাংস ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে না তো? আর সেই মেয়েটাকে শুনতে হবে না তো, এমন তো হয়েই থাকে! কিংবা মেয়েটা ছোটখাটো পোশাক পরেছিল। কিংবা মেয়েটা খারাপ চরিত্রের।’
এই নাটক তা হলে সিপিএমের পক্ষে এবং তৃণমূলের বিপক্ষে? এই পক্ষে-বিপক্ষে মার্কা ছেঁদো প্রশ্ন নিরর্থক। ধর্ষণ যুগযুগান্ত বেয়ে আসা সামাজিক ব্যাধি। কখনও রামায়ণে ইন্দ্র অহল্যার শরীরের দখলদারি চেয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। কখনও বা রোমে রাজপুত্র টারকুইন এক সভাসদের স্ত্রী লুক্রেশিয়ার শরীরে আক্রমণ শানান। ধর্ষণে যৌনতা যতটা দায়ী, তার চেয়েও বেশি দায়ী নারী-পুরুষ ক্ষমতার ফারাক। ‘ধর্ষণের চেয়ে আমাদের এখানে নারীদের ওপর অন্য অপরাধ বেশি’ জাতীয় ধরতাই আসলে অসাম্যকেই স্বীকৃতি দেওয়া।
কিন্তু নারীর ওপর দখলদারির তো অনেক রাস্তা। যৌন অত্যাচার কেন? এখানেই আলোচনা দরকার। নারীবাদী তাত্ত্বিক নাওমি উল্ফ তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘ভ্যাজাইনা: এ নিউ বায়োগ্রাফি’তে জানাচ্ছেন, যোনির সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগ স্বতোৎসারিত। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনতাবোধ, সৃজন-অনুভূতি সবই ওই রাসায়নিক-স্নায়বিক পথে পরিবাহিত হয়। অতএব, কোনও মেয়েকে চিরতরে ঠুঁটো করে রাখতে হামলা চালাতে হবে ওই পথে। ধর্ষিতা মেয়েদের নিয়ে নাওমির অভিজ্ঞতা অন্য। সামান্য পরিশ্রমে তাঁদের কাঁধ ঝুঁকে পড়ে। টাল সামলাতে পারেন না। মাথা ঘোরা, কানে সারাক্ষণ কিচকিচ আওয়াজ। হাত, পা চলে গেলে তাও ক্ষতিপূরণ মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু চিরজীবন আফটার-শকে ভুগতে-থাকা মস্তিষ্কের ক্ষতিপূরণ? খুন হয়ে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ?
শঙ্খ ঘোষ এই ঘটনাটাই মেনে নিতে পারছেন না। “ভয়ঙ্কর মুহূর্তে সরকারপক্ষের প্রথম প্রতিশ্রুতি, টাকা দেব। চাকরি দেব। কামদুনির ‘চাই না’ বরং আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে পারে আমাদের সমাজে।”
এই নাটকে ক্ষতিপূরণের রাজনীতি নেই। আছে অন্য জিনিস। মৃত মেয়েটিকে চোখের সামনে দেখতে পায় ভুলু। আর সেই হ্যালিউসিনেশন থেকে বলে ওঠে, ‘আমার কাছে কেন? কত বড় মানুষ আছেন সমাজে, মন্ত্রী, ডাক্তার, নাট্যকার, তাদের কাছে যাও।’ কখনও বা আবৃত্তি করে জয় গোস্বামীর কবিতা, ‘ঘুমোচ্ছি আর/ টুং টাং টুং।’ বিদ্বজ্জনদের নীরবতাকেই বিদ্ধ করে এই নাটক!
সুরজিৎকে নিয়ে যিনি ‘হ্যামলেট’ করেছিলেন, সেই বিভাস চক্রবর্তীও নাটক দেখেছেন, ‘সুরজিতের অভিনয় ভাল। কিন্তু নাটকটা কী নিয়ে বেশ, ভুলে গেছি।’ বিদ্বজ্জনদের নীরবতার কথা তুলতে তাঁর জবাব, ‘‘আমি অনেক দিন ধরে একটি এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত। ঘটনার পরেই প্রতুল (মুখোপাধ্যায়) সেই সংস্থার হয়ে কামদুনি গিয়েছিল। কে কোথায় যাচ্ছে, সবই টিভিতে ঘোষণা করে জানাতে হবে?” উত্তেজিত তিনি, “বিদ্বজ্জন কি শুধু যাঁরা ১৪ নভেম্বর মিছিল করেছিলেন? অন্যরাও তো আছেন। বিদ্বজ্জনেরা যাচ্ছেন না কেন, এই প্রশ্নটাই রাজনীতি। আর রাজনীতিকদের দেখলে এখন রাগ হয়।”
শঙ্খ ঘোষ স্থিতধী, “কিছুকাল আগে যে বিশাল মিছিল বেরিয়েছিল, তার পর থেকেই জনমানসে এই চাহিদা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তুঙ্গ মুহূর্তেই ওই রকম ঘটতে পারে, সব সময় হয় না।”
নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ডাক্তার চরিত্রটি। কাউন্সিলর এসে ভুলুকে চোখরাঙানি দেন, ‘জগার নামে অভিযোগ তুলে নিন। আমাদের সঙ্গে আছে, ভাল ছেলে।’ ডাক্তার ভয় দেখান না, বন্ধুর মতো বলেন, ‘ভুলতে চাইলেই ভোলা যায়।’ ক্ষমতা সব সময় ভয় দেখায় না। বরং হিতৈষীর ভঙ্গিতে বলে, ‘মেনে নাও।’ “নাটকের ইন্টারেস্টিং জায়গা ওটাই। যে লোকটাকে এত দিন সবাই মনে রাখো, মনে রাখো বলছিল, প্যাঁচে পড়ে শেষে তাকেই বলল, ভুলে যাও। ভুলতে শেখো। এটাই আমাদের সমাজ,” হাসছিলেন কৌশিক। সবাই ভোলে না। দর্শকাসনের মহিলারা যেমন। ৯ জুন সকালের কাগজে কামদুনিকাণ্ড বেরোনোর পর সন্ধ্যাতেই স্ট্যান্ডিং ওভেশন! |
বিভাস চক্রবর্তী
সুরজিতের অভিনয় ভাল। কিন্তু নাটকটা ঠিক মনে
পড়ছে না। নাটকটা মনে রাখার মতো নয় এমনও বলছি না |
|
কৌশিক সেন
চমৎকার নাটক! সুরজিৎ এই সময়ের
শক্তিশালী, কিন্তু আন্ডাররেটেড অ্যাক্টর |
|
শঙ্খ ঘোষ
প্রতিবাদ এক জিনিস, সামাজিক ভাবে
প্রতিরোধ করার স্থায়ী আন্দোলন আর এক |
|
|
|
|
|
|