স্কুল রয়েছে বাড়ির পাশে। তবু প্রতি দিন ২০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে যেতে হয় প্রিয়ব্রত দেবনাথকে। হুগলি সীমানা-ঘেঁষা বর্ধমানের মাধবডিহির প্রিয়ব্রত মাধ্যমিক পাশ করেছিল বাড়ির পাশের স্কুল থেকেই। কিন্তু সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। অথচ, প্রিয়ব্রতর জেদ, সে বিজ্ঞান নিয়েই পড়বে। অগত্যা সাইকেল, বাস ঠেঙিয়ে তাকে ছুটতে হয় হুগলির আরামবাগে।
এ রাজ্যে প্রিয়ব্রতর মতো বহু পড়ুয়াকেই মাধ্যমিক পাশ করার পরে বিজ্ঞান পড়তে হলে ছুটতে হয় পাশের ব্লক, কি পাশের জেলার স্কুলে। না হলে ইচ্ছা সত্ত্বেও অঙ্ক কিংবা জীবনবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা হয়ে ওঠে না। কলকাতা আর তার আশপাশের জেলাগুলোর অধিকাংশ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে বিজ্ঞান রয়েছে। কিন্তু দূরের জেলায় খুব কম স্কুলেই বিজ্ঞান পড়ানো হয়। গত বছর প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল, কলকাতায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ২০ শতাংশ ছাত্র ফিজিক্স নিয়ে পড়ছে, কোচবিহারে পড়ছে মাত্র চার শতাংশ।
রাজ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে ২৬০৩টিতে। অর্থাৎ, অর্ধেকেরও কম স্কুলে। সেই সুযোগেরও অনেকটাই নির্ধারণ করে ভৌগোলিক অবস্থান। উত্তরবঙ্গের প্রায় ৬৫% স্কুলেই বিজ্ঞান বিভাগ নেই। চলতি বছরে উত্তরবঙ্গের ছ’টি জেলায় মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মোট পড়ুয়ার সংখ্যা এক লক্ষ ৬৫ হাজার। কিন্তু সব স্কুল মিলিয়ে বিজ্ঞান পড়ার আসন রয়েছে সাড়ে দশ হাজার। অর্থাৎ, মাত্র ৬% পড়ুয়া বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ পেতে পারে উত্তরবঙ্গে।
জলপাইগুড়ি ও মালদহে প্রায় ৫০% স্কুলে বিজ্ঞান রয়েছে। উত্তর দিনাজপুরে বিজ্ঞান বিভাগ আছে প্রায় ৪০% স্কুলে। কিন্তু দক্ষিণ দিনাজপুর ও কোচবিহারে ৭০%-এর মতো স্কুলে বিজ্ঞান নেই। দার্জিলিংয়ে মাত্র ২৫% স্কুলে এই সুযোগ রয়েছে। দার্জিলিং ও দক্ষিণ দিনাজপুরে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যাও অন্য জেলার থেকে কম।
দক্ষিণবঙ্গে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুর, বর্ধমান ও উত্তর ২৪ পরগনার অধিকাংশ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলেই বিজ্ঞান রয়েছে। নদিয়ায় ৬০%, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ায় প্রায় ৫০% স্কুলে বিজ্ঞান রয়েছে। তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ।
শিক্ষকদের দাবি, স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হচ্ছে না পরিকাঠামোর সমস্যার জন্য। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা বা রসায়ন পড়াতে হলে গবেষণাগার রাখতেই হবে। উত্তর দিনাজপুরের স্কুল পরিদর্শক নারায়ণ সরকার বলেন, “বেশির ভাগ হাই স্কুলে গবেষণাগার না থাকায় বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।” তাঁর সঙ্গে এক মত অন্য জেলাগুলির স্কুলশিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরা। বিজ্ঞান পড়াতে হলে স্কুলে প্রয়োজন ভাল মানের গ্রন্থাগারও। কোথাও পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, কোথাও গ্রন্থাগার তৈরির সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, দাবি ওই আধিকারিকদের। কোনও স্কুলে আবার বিজ্ঞান বিভাগ চালু করলেও ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হতে চায় না, বলেন অনেক শিক্ষক।
রাজ্যের স্কুলগুলিতে বিজ্ঞান পড়ার এই সীমিত সুযোগের দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গত বছর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে প্রতীচী ট্রাস্ট। ‘সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড দ্য প্রিভিলেজ ডিভাইড: আ কেস অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ রিপোর্টে এ-ও দেখা যায় যে, সর্বশিক্ষা অভিযানের নিয়ম অনুসারে উচ্চ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য শিক্ষকদের অন্তত ৫০% বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু এ রাজ্যে তা হচ্ছে না। “এ বছরও স্কুল সার্ভিস কমিশনে যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের বড় জোর ১০% বিজ্ঞানের ছাত্র,” বলেন ওই রিপোর্টের প্রণেতা অশোকেন্দু সেনগুপ্ত। স্কুলে বিজ্ঞানের সীমিত চর্চার ফলে, রাজ্যে মাত্র ১৪% কলেজপড়ুয়া বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে।
এই রিপোর্ট বেরোনোর পর রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসে। ২০১১ সালে ১৯৭৩টি স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল, দু’বছরে আরও ৬৩০টি স্কুলে তা চালু হয়েছে। তবে স্কুলশিক্ষা দফতরের এক আধিকারিকের বক্তব্য, একাদশ-দ্বাদশে বিজ্ঞান পড়ানোর পরিকাঠামো তৈরিতে অনেক স্কুলই আগ্রহ দেখায় না। খরচ বেশি বলে অনেক পড়ুয়াও বিজ্ঞান এড়িয়ে চলে। গ্রামের স্কুলগুলিতে বিজ্ঞান শিক্ষকও সহজে মেলে না।
সমস্যাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। শনিবার তিনি বলেন, “যে সব স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, সেগুলিতে পরীক্ষাগারের জন্য অনুদান দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, নতুন নতুন স্কুলকে একাদশ-দ্বাদশে বিজ্ঞান বিভাগ খুলতে বলা হচ্ছে।” তিনি জানান, পরিকাঠামো তৈরিতে সরকার স্কুলগুলিকে সাহায্য করবে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ পরীক্ষার ফল বেরোলে বিজ্ঞানের শিক্ষকও দেওয়া হবে, আশ্বাস দেন তিনি। |