|
|
|
|
|
|
|
একটা ভয় কষ্ট লজ্জা[ঘেন্না] |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
ঘটনাটা বছর পনেরো আগেকার। আমাদের বয়সটা তখন পাটভাঙা হলুদ শাড়ির মতো উজ্জ্বল আর নুনছাল উঠে-যাওয়া চামড়ার মতো সংবেদনশীল। দিনটা ছিল এমনি আরও একটা দিনের মতো। যে ধরনের দিন প্রাত্যহিকতাকে ধরে রাখে না বাতাসে এক্সট্রা জলীয় বাষ্প, না পারদ চড়ানো তাপমাত্রা, না বসন্তের ঝিরঝিরে হাওয়া। রাস্তায় সাধারণ বুরবক মানুষজন, সাড়ে আটটার পর মোটামুটি ফাঁকা মেট্রো স্টেশন।
আমার বান্ধবী টিউশন পড়া শেষ করে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে পরের ট্রেনের অপেক্ষায়। রবীন্দ্র সরোবর যাবে। মনে মনে ক্যালকুলেশন বলছে, যদি ৯টা ১-এর মেট্রো পাই, তা হলে স্টেশনে নেমে বাড়ি পৌঁছে যাব সাড়ে ন’টার মধ্যে। মা একটু চিন্তা করবে, কিন্তু ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।
স্টেশনে ইতিউতি লোক। একটা মাঝবয়সী মোটা গোঁফওলা লোক সমানে ওকে দেখে চলেছে। কী অসভ্য রে বাবা! যতই ঘুরে দাঁড়ায়, ঠিক কোনও বাহানা করে সামনে চলে আসছে। বিরক্ত হয়ে ও এ বার চলে যায় অন্য প্রান্তে, কায়দা করে দাঁড়ায় একটা থামের আড়ালে। কেউ বড় একটা নেই এ দিকটায়। এ বার দেখি তো কেমন দেখতে পায় লোকটা আমায়। স্বস্তিতে দু’মিনিট দাঁড়ানোর পরই একটা কী যেন ভয়ঙ্কর অস্বস্তি। এ রকমটা কখনও আগে তো মনে হয়নি। এটা কী হচ্ছে! কী যেন একটা ছিটকে এসে লাগল। চকিতে ঘুরে দাঁড়াতেই বজ্রাঘাত, গা গুলনো, বিস্ময়, ঘেন্না, রাগ, অপমান এবং আর যা যা হতে পারে, সব একসঙ্গে। যা হল, তা বিশ্বাসযোগ্য কি? সে কি সত্যিই সেই মেয়ে যার সালোয়ার কামিজের প্রথমে পেছনে এবং ঘুরে দাঁড়াতেই সালোয়ারের সামনে, গায়ে ছিটকে এসে লাগল এক জন মধ্য তিরিশের লোকের বীর্য?! মানে কিনা, একটা লোক মাস্টারবেট করে আমার বান্ধবীর গায়ে ইজাকুলেট করে দিল। মেট্রো স্টেশনের প্রায় ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে।
এত অতর্কিতে এত বড় shock. বিশ্বাস করতে পারছিল না কিছু ক্ষণ। কী করবে? কাঁদবে খুব জোরে? লোকটাকে চড় মারবে? লোক ডাকবে? অপমান করবে? আর কী দৃশ্য সে দেখল! আর লোকটা? সে তখন গুটখা খাওয়া দাঁত বের করে হেসে প্যান্টের চেন টানতে টানতে পকেটে হাত মুছতে মুছতে চলে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মের অন্য প্রান্তে।
আমার বান্ধবী একা, নোংরা হয়ে দাঁড়িয়ে। দুহাতে কাচিয়ে নিয়েছে সব অপমান, সব ওয়াক, আত্মহত্যা না করার শক্তি। কেবল শিরায় শিরায় বইছে অসহ্য ঘেন্না। কেউ যেন অজস্র কাচ ফুটিয়ে চলেছে ওর শিরা-উপশিরা-মেরুদণ্ড-হৃদপিণ্ডে। এত জোর চিৎকার করতে ওর কোনও দিন ইচ্ছে হয়নি, এত রাগ ওর কোনও দিন হয়নি, এত কষ্ট ও কোনও দিন পায়নি।
বাড়ি ফিরে এল। ওর মনে হয়েছিল, গোটা ট্রেন জানে ওর সঙ্গে কী হয়েছে। প্রতিটি মানুষ ওকে দেখেছে, প্রতিটি মানুষ বোধ হয় ওকে জিজ্ঞেস করেছে অ্যাই মেয়ে, তোমায় জামায় কী লেগে? আমার অপমান হুজুর! আমার নারীত্ব মন্থনে উঠেছে পেস্টের মতো যে লেই, সেটাই লেগে রয়েছে আমার জামায়, আমার আত্মায়। কী ভাবে বাকি পথ এসেছিল ওর মনে নেই। এমন থমথমে মুখে বাড়ি ফিরেছিল যে মাসিমা ভেবেছিলেন ‘সাংঘাতিক’ কিছু হয়েছে। যে সাংঘাতিকটার ভয় যুবতী মেয়ের মায়েরা পায়। খুব ঠান্ডা গলায় ও বলেছিল, মা আমার জামাটা ফেলে দিও। মাসিমা আন্দাজ করেছিলেন।
পরের ক’দিন গেছিল কেবল কেঁদে। অনেক কান্না আমরা সবাই কেঁদেছিলাম। আর ক্রমে কাচা-ধোয়ার ব্যারামটি আমার বান্ধবীকে পাইয়া বসিল, ঝলমলে মেয়ে হয়ে গেল ওয়াশিং মেশিন-এর সমার্থক। যে কিনা সব সময়ই সব ধুয়ে ফেলছে। বাড়ি ফিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথরুমে ওড়না কাচছে। রুমালে এক কণা নোংরা দেখলেই ওয়াক তুলছে। খাতা রাখার আগে বেঞ্চিটা পাগলের মতো ঘষছে আর তাই দেখে হেসে হাল্লাক হয়ে যাচ্ছে ছাত্ররা আর টিচার-মশাই। |
|
|
|
|
|