শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান
আজকের হিরো: হাংরি আন্দোলন
মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়।... এখন কবিতা রচিত হয় অর্গ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।
১৯৬২ সালে এই ভাষাতেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে খালাসিটোলা, বারদুয়ারি অবধি সর্বত্র গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের ব্লু প্রিন্টের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি ম্যানিফেস্টো। ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া থেকে প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোর ওপরে লেখা হাংরি জেনারেশন। নীচের লাইনে তিনটি নাম। স্রষ্টা: মলয় রায়চৌধুরী। নেতৃত্ব: শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনা: দেবী রায়।
তখনও কলেজ স্ট্রিটের বাতাসে আসেনি বারুদের গন্ধ, দেওয়ালে লেখা হয়নি ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’। কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়ে-যাওয়া এই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব অন্যত্র। এর আগে ‘ভারতী’, ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ অনেক কবিতার কাগজ ছিল, সেগুলি ঘিরে কবিরা সংঘবদ্ধও হতেন। কিন্তু এই ভাবে সাইক্লোস্টাইল-করা ম্যানিফেস্টো আগে কখনও ছড়ায়নি বাংলা কবিতা।
ওটি হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো। প্রথম ম্যানিফেস্টোটি বেরিয়েছিল তার কয়েক মাস আগে, ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে। ইংরেজিতে লেখা সেই ম্যানিফেস্টো জানায়, কবিতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, বিভ্রমের বাগানে পুনরায় বৃক্ষরোপণ করে না। ‘Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of bamboozled gardens.’ বিশ্বায়নের ঢের আগে ইংরেজি ভাষাতেই প্রথম ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন হাংরি কবিরা। কারণ, পটনার বাসিন্দা মলয় রায়চৌধুরী ম্যানিফেস্টোটি লিখেছিলেন। পটনায় বাংলা ছাপাখানা ছিল না, ফলে ইংরেজি।
দুটি ম্যানিফেস্টোতেই শেষ হল না ইতিহাস। হাংরি আসলে সেই আন্দোলন, যার কোনও কেন্দ্র নেই। ফলে শহরে, মফস্সলে যে কোনও কবিই বের করতে পারেন তাঁর বুলেটিন। ১৯৬৮ সালে শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘মুক্ত কবিতার ইসতাহার’-এ ছাপিয়ে দিলেন ‘সমস্ত ভন্ডামির চেহারা মেলে ধরা’, ‘শিল্প নামক তথাকথিত ভূষিমালে বিশ্বাস না করা’, ‘প্রতিষ্ঠানকে ঘৃণা করা’, ‘সভ্যতার নোনা পলেস্তারা মুখ থেকে তুলে ফেলা’ ইত্যাদি ২৮টি প্রতিজ্ঞা। পরে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বাধবে। মলয় ব্যাংকের চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবেন। শৈলেশ্বর, সুবো আচার্য এবং প্রদীপ চৌধুরীরা বলবেন, ‘মলয় বুর্জোয়া সুখ ও সিকিয়োরিটির লোভে আন্দোলন ছেড়ে চলে গিয়েছে।’
কী রকম লিখতেন হাংরিরা? বছর দুয়েক আগে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে গৌতম ঘোষের চরিত্রটি লেখা হয়েছিল হাংরি কবিদের আদলে।
জেগে ওঠে পুরুষাঙ্গ নেশার জন্য হাড় মাস রক্ত ঘিলু শুরু করে কান্নাকাটি
মনের বৃন্দাবনে পাড়াতুতো দিদি বোন বউদিদের সঙ্গে শুরু হয় পরকীয়া প্রেম
’,
লিখেছিলেন অকালপ্রয়াত ফাল্গুনী রায়। র্যাঁবো, উইলিয়াম বারোজ এবং হেনরি মিলারের উদাহরণ বারে বারেই টেনেছেন হাংরিরা। ঘটনা, এঁরা যত না ভাল কবিতা লিখেছেন, তার চেয়েও বেশি ঝগড়া করেছেন। এবং তার চেয়েও বেশি বার গাঁজা, এলএসডি, মেস্কালিন আর অ্যাম্ফিটোমাইন ট্রিপে গিয়েছেন।
অতএব, সাররিয়ালিজ্ম বা অন্য শিল্প আন্দোলনের মতো বাঙালি কবিদের ম্যানিফেস্টোটি কোনও দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। কিন্তু ‘হাংরি’রা আজও মিথ। এক সময় ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ বলে তৎকালীন মন্ত্রী, আমলা, সম্পাদকদের বাড়িতে ডাকযোগে তাঁরা মুখোশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার এক সময় ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার জন্য অশ্লীলতার মামলা হল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে। উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাকের বিরুদ্ধে জারি হল গ্রেফতারি পরোয়ানা।
রাষ্ট্র ও আদালত কী ভাবে কবিতাকে দেখে, সেই প্রতর্কে ঢুকতে হলে ১৯৬৫ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাটি সম্পর্কে জানা জরুরি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কাঠগড়ায় উঠেছেন মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। পাবলিক প্রসিকিউটরের জিজ্ঞাসা, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?
ভাল লাগেনি।
প্রসিকিউটর: অবসিন কি? ভাল লাগেনি বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
ভাল লাগেনি মানে জাস্ট ভাল লাগেনি। কোনও কবিতা পড়তে ভাল লাগে, আবার কোনওটা ভাল লাগে না।
শক্তি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন মলয়ের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয়ের সমর্থনে...
প্রসিকিউটর: কবিতাটা কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?
সুনীল: কই, না তো। আমার তো বেশ ভাল লাগছে। বেশ ভাল লিখেছে।
প্রসিকিউটর: আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?
সুনীল: না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সে সব কিছু হয় না।
একই মামলায় শক্তি ও সুনীল পরস্পরের বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় কথা, ’৬৫ সালে এই সাক্ষ্য দেওয়ার আগের বছরই সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে বেশ কড়া একটি চিঠি দিয়েছিলেন, ‘লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার ঝোঁক বেশি। রাত্রে তোমার ঘুম হয় তো? মনে হয়, খুব একটা শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার।’ ব্যক্তিগত চিঠিতে অনুজপ্রতিম মলয়কে ধমকাচ্ছেন, কিন্তু আদালতে তাঁর পাশে গিয়েই দাঁড়াচ্ছেন। সম্ভবত, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে অনুজ কবিদের কাছে সুনীলের ‘সুনীলদা’ হয়ে ওঠা হাংরি মামলা থেকেই। প্রবাদপ্রতিম কৃত্তিবাসী বন্ধুত্বের নীচে যে কত চোরাবালি ছিল, তা বোঝা যায় উৎপলকুমার বসুকে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি চিঠি থেকে, ‘প্রিয় উৎপল, একদিন আসুন।...আপনি তো আর শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না।’
তা হলে কি হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে প্রভাবহীন, শুধুই কেচ্ছাদার জমজমাট এক পাদটীকা? দুটি কথা। হাংরিদের প্রভাবেই কবিতা-সংক্রান্ত লিট্ল ম্যাগগুলির ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ গোছের নাম বদলে যায়। আসে ‘ক্ষুধার্ত’, ‘জেব্রা’, ‘ফুঃ’-এর মতো কাগজ। সেখানে কবিতায় বাঁকাচোরা ইটালিক্স, মোটাদাগের বোল্ড ইত্যাদি হরেক রকমের টাইপোগ্রাফি ব্যবহৃত হত। পরবর্তী কালে সুবিমল মিশ্রের মতো অনেকেই নিজেকে হাংরি বলবেন না, বলবেন ‘শুধুই ছোট কাগজের লেখক’। কিন্তু তাঁদের গল্প, উপন্যাসেও আসবে সেই টাইপোগ্রাফিক বিভিন্নতা। তৈরি হবে শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। হাংরিরা না এলে কি নব্বইয়ের দশকেও হানা দিতেন পুরন্দর ভাট?
আসলে, ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই ছিল মৃত্যুঘণ্টা। ’৬২ সালে হাংরিদের প্রথম বাংলা ম্যানিফেস্টোর শেষ লাইন, ‘কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতো অনুষ্মেষিণী।’ হাংরিরা নিজেদের যত না সাহিত্যবিপ্লবী মনে করেছেন, তার চেয়েও বেশি যৌনবিপ্লবী। সুনীল, শক্তিরা পরে হাংরিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। কিন্তু ১৯৮১ সালে ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকার হয়ে শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন অরুণেশ ঘোষ...
অরুণেশ: অনেক সমালোচক বলেন, হাংরি সাহিত্য ভারতবর্ষে যৌন বিপ্লবের প্রেরণা দিয়েছে...
এ হল আবার সেই বাড়িয়ে ভাবার প্রবণতা। হাংরি সাহিত্য কি সত্যি সত্যি এত দূর বিস্তারিত যে গোটা ভারতবর্ষের যৌন বিপ্লবের প্রেরণা হতে পারবে সে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.