রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
সুমনামি
ত দূর মনে পড়ে, ‘ডাক হরকরা’ ছবিটি বাবা আমাদের দুই ভাইকে দেখতে পাঠিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে। আমার বয়স তখন ন’বছর। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে তৈরি করা ছবিটির একটি দৃশ্য বাদে বিশেষ কিছুই আমার মনে নেই। ‘ওই লাল পাগুড়ি বেঁধে মাথে রাজা হলে মথুরাতে’ গানটির সঙ্গে নাচ। বড়দের কাছে শুনেছিলাম ছবিতে ওই নাচটি নেচেছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। দৃশ্যটির কথা মনে পড়লে আজও, পঞ্চান্ন বছর পরেও, নিরঙ্কুশ মুগ্ধতা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করি না। গানটির সুর তাল ছন্দ যন্ত্রানুষঙ্গ এবং গায়কের গায়কি অপ্রতিরোধ্য ছেলেধরার মতো আমায় ধরে ফেলেছিল। তারাশঙ্করের লেখা গানের কথার রস পেতে পেতে আরও কিছু বছর পার করতে হয়েছিল, কিন্তু ছেলেধরাটি এমনই যে প্রায় গোটা গানটিই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল আমার মনে ওই এক-শোনাতেই।
‘এখন আমি নালিশ করি
মাখন চুরি বসন চুরি
শেষে মন অপহরি ফেরারি তোর গেল কোথা’
আর কি কখনও কবে /এমন লিরিক হবে। ক্ষমা করো, রবীন্দ্রনাথ। আমি নাস্তিক। সুকুমার রায়ের মতো তুমি আমার গানের অন্তর্যামী। তুমি বুঝবে কোন ব্যক্তিগত অক্ষমতার উপলব্ধি থেকে আমি এটা বললাম। ‘বেঁধে এনে বিচার করো শুনব না তো ছুতোনাতা’। রবীন্দ্রনাথ আমার, আমি তো পারিইনি, তুমিও কি পেরেছ! বাংলার ঘরের কথাগুলোকে এ ভাবে আধুনিক বাংলা গানে নাচিয়ে দেওয়া, কাঁদিয়ে দেওয়া, হাসিয়ে দেওয়া, ভাসিয়ে দেওয়া! ‘ছুতোনাতা’! মরেই যাব। সেই সঙ্গে সুর তাল ছন্দ। তোমার জন্য আর হিমাংশু দত্তর জন্য আমার মায়া হয়, রবীন্দ্রনাথ। তোমরা দুজন যদি সুধীন দাশগুপ্তর সুর-রচনা শুনতে। আরও মায়া হয় এ বারে কাজী নজরুল ইসলামের নামটিও যোগ করলাম। তোমরা তিন জন যদি মান্না দে’র গায়কি শুনতে!
তুমি তো জানো, মাসে তুমি মাত্র পঁচিশ টাকা বৃত্তি দেবে বলে সে যুগের যে বাঙালি যুবক তোমার পায়ের কাছে বসে গান শেখার সুযোগ পেয়েও তা নেননি, সেই যুবকটি তাঁর মধ্যবয়সে তাঁর ছোট ছেলেকে তোমারই গান ‘আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে’ শেখাচ্ছিলেন মহা বকাবকি করে, হারমোনিয়ামের বেলোয় তাল ঠুকে ঠুকে। একই তালে, প্রায় একই ছন্দে আর একই লয়ে মান্না দে গাইছিলেন ‘লাল পাগুড়ি’ যদিও সুর একেবারেই আলাদা। আর, তা শুনে ফেলার পর কিশোর শিক্ষার্থীর মন চলে যাচ্ছিল ‘নবীন মেঘের সুর’ থেকে ‘বাঁশি ছেড়ে দণ্ড হাতে/ বঁধু হলে দণ্ডদাতা’-য়। তোমার না-শোনা একটি পুরুষকণ্ঠ তখন আমাদের দেশের জল-হাওয়ার গন্ধমাখা গায়কিতে গাইছেন: ‘এখন কলঙ্কিনী রাধায় দণ্ড না দিলে মান থাকে কোথা’। ওই ‘রাধায় দণ্ড’টুকু গেয়ে যে ভাবে তিনি ‘না দিলে’-র ‘না’টায় গলার ওজনটা লাগালেন, যে ভাবে তিনি তারসপ্তকের সা থেকে কোমল নি ছুঁয়ে পুরনো বন্ধুর কুশল শুধানোর মতো সহজ করে নিধপম/ গরেসা রেগ- শুদ্ধ গা-তে এলেন তোমার কী হল জানি না, আমার বারোটা বেজে গেল।
আজ, জগৎসংসারের অনেক কিছু থেকে দূরে সরে এসে, মানুষজনের থেকে যথাসম্ভব দূরত্বে এসে যখন নিজের সঙ্গে ঘর করছি, তখন মাঝে মাঝে ভাবি শান্তিদেব ঘোষ যখন শট দিচ্ছিলেন, মান্না দে’র গাওয়া এই গানটি সম্ভবত ‘ন্যাগ্রা’ ফিল্ড রেকর্ডারে লাগানো বড় স্পিকারে শুনতে শুনতে তাঁর কী মনে হচ্ছিল। আর কী কখনও কবে/ এমন দৃশ্য হবে।
ছবি: সুমন চৌধুরী
দৃশ্য কী ছিল মনে নেই। বাংলা ছবিতে গান শুরু হলেই আমি চোখ বুজে ফেলি। কদাচিৎ চোখ খুলে ফেলেই বন্ধ করে ফেলেছি কয়েক বার লজ্জায় আর, দু’এক বার, রাগে। সত্যজিৎ রায়ের একটি ছবিতে আচমকা ‘এ পরবাসে’ গানটি শুনে ও দেখে, রবীন্দ্রনাথই জানেন কেন, এমন রাগ হয়েছিল যে পেটব্যথা শুরু হল। ‘ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ার’ সুযোগ আমি পাইনি। পড়শি দর্শকদের চাপা বকুনি শুনতে শুনতে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। আর এক বার, আমারই বাঁধা একটি ছবির গানে লিপ দিতে গিয়ে এক হিরো ‘সুর’ কথাটা বলার জন্য ঠোঁট দুটো এমন উৎকট ভাবে ছুঁচলো করেছিলেন যে সেই অপদৃশ্য আমি আজও মাথার কোথায় যেন একটা বয়ে বেড়াচ্ছি। ‘সুর’-এর ওপর ছোট্ট একটু কাজ ছিল। তাই বলে ঠোঁটদুটো অত ছুঁচলো করে রাখতে হবে? মঙ্গল হোক সেই হিরোর। কিন্তু আমার ‘ব্যর্থ প্রাণের’ এই বিশেষ ‘আবর্জনা’টা ‘পুড়িয়ে ফেলা’র মতো ‘আগুন’ আমি আজও জ্বালতে পারিনি।
‘মন রে আমার হায় শুনলি না বারণ’ গানটি যখন শুরু হল আমি চোখ বুজে ফেললাম। ‘ডাক হরকরা’র ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’ গানটি বেতারে তবু কয়েক বার শোনা গিয়েছে সে যুগে। ‘মন রে আমার’ গানটি বেতারে বার দুয়েকের বেশি বেজেছে কিনা সন্দেহ। অনেকটাই আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল দর্শকের আসনে বসে শুনতে শুনতেই। বোধ হয় একটি মাত্র একতারা বাজছে। পল্লিগীতি ঘেঁষা সুর, কিন্তু আধুনিক গান। মন্দ্রসপ্তকের পা থেকে তারসপ্তকের শুদ্ধ মা পর্যন্ত সুরের পরিসর। ‘মন রে আমার’ যাচ্ছে মধ্যসপ্তকের পা থেকে কোমল নি আর তারসপ্তকের সা ছুঁয়ে সটান কোমল গা। মান্না দে দাঁড়িয়ে আছেন সেই পরদায় খোলা গলার আওয়াজে। তার পর সূক্ষ্ম একটি মোচড় দিয়ে শুদ্ধ মা, সেখান থেকে কোমল গা হয়ে তারের সা। শুধু ‘মন রে আমার’ কথাগুলির জন্য সুরের এই গতিপথ। আজও দিন-দুপুরে এই গানের শুধু এইটুকু, মান্না দে’র গলার নিখুঁত সুর আর তাঁর মুক্ত স্বরপ্রক্ষেপ মনে করলে দুপুরের খোলা আকাশটাকে দেখতে পাই।
এর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাই একমাত্র আকাশবাণীর সিগনেচার টিউনের। পেছনে একটি তানপুরা বেজে চলেছে অনুচ্চ। সামনে তীক্ষ্ন একটি যন্ত্রে (ওটি কি ‘ইউনিভক্স’ গোছের কোনও ইলেকট্রনিক যন্ত্র, না অন্য কিছু) তালহীন সুরে বেজে চলেছে: তারসপ্তকের কোমল গা থেকে তারের শুদ্ধ রে ছুঁয়ে মধ্যসপ্তকের শুদ্ধ ধা/ তারের রে, সা, মাঝের শুদ্ধ ধা, পা/ শুদ্ধ ধা, তারের সা, শুদ্ধ ধা, পা। কী এক সময়হীনতা, কোন অনন্ত যে রাখা আছে আকাশবাণীর এই সুরে! তানপুরার পটভূমিতে তীক্ষ্ণ বাজনাটির আওয়াজ আমার কাছে আজও একটা সংকেত। দুপুরের আকাশ জুড়ে সমস্ত ভাবনা হারিয়ে ফেলার ডাক। ‘ডাক হরকরা’ ছবিতে মান্না দে’র গাওয়া ‘মন রে আমার’ একই আবেদন রাখে আমার কাছে।
‘সোনার হরিণ ধরতে গেলি
ঘরে হল সীতাহরণ
মন, শুনলি না বারণ’।

নিজের কাছে নিজের গল্প করছে গানটি। সত্যি বলতে, সেই সময় থেকে সাতের দশক পর্যন্ত এই বিরাট কণ্ঠশিল্পীর যে গানগুলি শুনেছি তার কোথাও কোথাও তিনি একটু বেশি আবেগ প্রকাশ করে ফেলেছেন বলে আমার মনে হয়েছে, এখনও মনে হয়। কিন্তু এই গান আর ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায়’-তে মান্না দে আবেগের আতিশয্য এড়িয়ে খোলা গলায় গায়কির এমন এক নজির রেখেছিলেন যা তিনি নিজে আর ক’বার ছুঁতে পেরেছেন কে জানে। সর্বযুগের এক সেরা টেনর শিল্পী মান্না দে’র গান শোনার যাত্রা আমার শুরু হয়েছিল ‘ডাক হরকরা’য়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.